আপডেট : ০৭ January ২০২১
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ ইসলাম পরিপূর্ণ দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হিসেবে জীবনের প্রত্যেক পরিস্থিতি সম্পর্কে যথাযথ দিকনির্দেশনা দিয়েছে। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে ইবাদতে আত্মস্থ হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যে কারণে ইসলামে শারীরিক ও মানসিকভাবে মুমিনরা যাতে সুস্থ থাকে, সে ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘দুর্বল মুমিনের তুলনায় সবল মুমিন অধিক কল্যাণকর ও আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। তবে উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে’ (মুসলিম)। ইসলাম সুস্থ থাকার জন্য স্বাস্থ্য পরিচর্যাকে গুরুত্ব দিয়েছে। অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা গ্রহণের চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সুস্থ থাকাকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : ‘কিয়ামতের দিন বান্দাকে নেয়ামত সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি করা হবে তা হলো তার সুস্থতা সম্পর্কে। তাকে বলা হবে আমি কি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দিইনি’ (তিরমিজি)? মানুষ অসুস্থ হলে যাতে চিকিৎসা গ্রহণ করে, সে ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজে অসুস্থ হলে চিকিৎসা গ্রহণ করতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর, কেননা মহান আল্লাহতায়ালা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি। তবে একটি রোগ আছে যার কোনো প্রতিষেধক নেই, সেটি হলো বার্ধক্য (আবু দাউদ)। ইসলামে রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হলেও হারাম জিনিসকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহারে নিষেধ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : ‘আল্লাহতায়ালা রোগ দেন, রোগের প্রতিষেধকও নাজিল করেছেন। প্রতিটি রোগের চিকিৎসা রয়েছে। সুতরাং তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর তবে হারাম দ্রব্য দ্বারা চিকিৎসা নিও না।’ তিনি আরো ইরশাদ করেছেন : ‘হারাম বস্তুতে আল্লাহতায়ালা তোমাদের জন্য আরোগ্য বা রোগমুক্তি রাখেননি’ (জাদুল মাআদ)। আর ইসলাম শিক্ষার মূল উৎস আল-কোরআন ও আল-হাদিস। যে কোনো সমস্যা মোকাবিলায় প্রথমেই তাই এ দুটি উৎসের দিকেই ফিরে যেতে হবে এমনই শিক্ষা ইসলামের। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শ, যাকে আমরা হাদিস ও সুন্নাহ হিসেবে জানি তা হলো মূলত আল-কোরআনের প্রায়োগিক রূপ। তাই তো রাসুলের আদর্শ সবার জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হিসেবে ঘোষণা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ (আল-কোরআন, ৩৩:২২)। মানুষের আবশ্যিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিধান এবং তা নিশ্চিতকল্পে তাঁর দিকনির্দেশনা যেমনি কার্যকর তেমনি অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিধানকে দুভাবে নিশ্চিত করেছেন- (ক) নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং (খ) অন্যের স্বাস্থ্যও নিশ্চিত করা। সে কারণে দুটি উপায়ের কথা নবীজির বাণীতে ও জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে- (১) রোগের প্রতিরোধ ও (২) রোগের প্রতিকার। প্রথমত এটি একটি সাধারণ প্রবাদ যে, ‘রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।’ রোগের প্রতিরোধ বলতে যেসব কারণে রোগ হয়, সেসব থেকে নিজে এবং অন্যকে মুক্ত রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখা। রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন- (১) পাক-পবিত্র (পরিচ্ছন্ন) থাকা। এ বিষয়টিকে তিনি ঈমানের অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন (সহিহ মুসলিম)। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অধিকাংশ রোগের মূল কারণ হলো অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন থাকা। পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিকে নিশ্চিত করতে কোরআনুল কারীমে পরিস্থিতি বিবেচনায় অজু ও গোসলকে ফরজ করে দেওয়া হয়েছে। (২) খাবার গ্রহণের ব্যাপারে সচেতন হওয়া। খাবার গ্রহণের ব্যাপারে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা সুস্থ থাকার জন্য অবশ্যম্ভাবী হিসেবে আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের পেটকে তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ খাবার, অন্যভাগ পানি এবং বাকি অংশ খালি রাখো।’ (৩) অশ্লীলতা ও পাপাচার ছেড়ে দেওয়া। মানুষের রোগের অন্য একটি কারণ হলো অশ্লীলতা, ব্যভিচার, সমকামিতা, স্বমেহন ইত্যাদি পাপাচার। এগুলোকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারাম (নিষিদ্ধ) এবং শাস্তিমূলক অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এগুলোর মাধ্যমে সংক্রমণজনিত রোগের বিস্তার এবং তা মহামারীতে রূপ নিতে পারে যা আজ বাস্তব। এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া, করোনা এসবের কারণ কী, তা অজানা নয়। এ ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা বিস্তার লাভ করে, তখন তাদের মধ্যে এমন সব সংক্রামক মহামারী ও যন্ত্রণাদায়ক রোগ দেখা দেয় যা তাদের আগের যুগে ছিল না’ (সুনান ইবনে মাজাহ)। দ্বিতীয়ত রোগ যদি আক্রমণ করে, তাহলে তার জন্য আল্লাহর কাছে যেমন দোয়া চাইতে হবে তেমনি ওষুধ সেবন করা বা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেওয়া সুন্নত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে ওষুধ গ্রহণ করেছেন, চিকিৎসা নিয়েছেন এবং তাঁর উম্মতদের তা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি নিজেই এ ব্যাপারে পাঁচটি পদ্ধতি অবলম্বন করতেন- (১) হাজামাত বা রক্তমোক্ষণ, (২) লুলুদ বা মুখে ওষুধ ব্যবহার, (৩) সাউত বা নাকে ওষুধ ব্যবহার, (৪) মাসীঈ বা পেটের বিশোধনের জন্য ওষুধের ব্যবহার, এবং (৫) কাওয়াই বা লোহা পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দেওয়ার মাধ্যমে আহত অঙ্গের চিকিৎসা করা। এসব পদ্ধতি আধুনিক যুগে প্রয়োগকৃত মূল চারটি পদ্ধতির সমন্বিত রূপও বলা যেতে পারে। যেখানে ডায়াগনসিস, ওষুধ, থেরাপি এবং অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সবধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসবের মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উৎসাহ দিয়েছেন বটে। তাঁর চিকিৎসা বিধানে মধু ও কালোজিরাকে মৃত্যু ছাড়া সব রোগের ওষুধ বিবেচনা করা হতো। ইমাম ইবনু কাইয়ুম আল-জাওযি (রহ.)-এর ‘তিব্বু নববি’ নামক বইতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কিত বিশদ আলোচনা স্থান পেয়েছে। তদুপরি এসব চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করতে অর্থের প্রয়োজন। সেখানে কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের পক্ষে সে ব্যয় বহন করার সামর্থ্য নাও থাকতে পারে। এ ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা হলো, অসামর্থ্যবান এসব অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা রাষ্ট্র, সামর্থ্যবান আত্মীয়-স্বজন কিংবা প্রতিবেশীরা করবেন। এটি ধনীদের প্রতি তাদের অধিকারও। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসে কুদসিতে বলেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা বনি আদমকে অনেকগুলো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবেন। তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো, ‘...যেদিন আমি (আল্লাহ) অসুস্থ ছিলাম সেদিন কেন আমাকে চিকিৎসা ও সেবা করাওনি? মানুষ বলবে, হে আল্লাহ আপনি কীভাবে অসুস্থ ছিলেন? প্রতিউত্তরে আল্লাহ বলেবেন, তোমার প্রতিবেশী কি অসুস্থ ছিল না? তাকে সেবা ও চিকিৎসা করলে আমারই সেবা ও চিকিৎসা করা হতো...’ (সহিহ বুখারি)। এই মূল শিক্ষাটি যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারতাম, তাহলে বিনা চিকিৎসায় কাউকে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মানুষগুলোর আকুতি ও কান্নার শব্দ শুনতে হতো না আমাদের। পৃথিবীতে অর্থের এতটা অভাব নেই যে, মানুষের চিকিৎসা করা যাবে না। অর্থের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে পারলে এবং নিজেদের মধ্যে মানবতাবোধকে জাগ্রত করতে পারলে কখনোই এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন আমাদের হতে হতো না। আজকের বিশ্বে সেরা ২০ জন ধনী ব্যক্তির কাছে সম্পদের বিবেচনায় নিচের দিকে থাকা ২৫০ কোটি মানুষের সমান সম্পদের মালিক তারা। ‘ধনীর সম্পত্তিতে গরিবের অধিকার রয়েছে’ (আল-কোরআন, ৫৬:৫১)। হাদিসে এসেছে, ‘উদরপূর্ণ ব্যক্তির ইবাদত কবুল হবে না, যদি তার প্রতিবেশী বুভুক্ষু অবস্থায় থাকে’ (সহিহ মুসলিম)। এসব শিক্ষা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারলে বিশ্বচিত্র পরিবর্তন হয়ে সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান সুখী সমাজ আমরা দেখতে পারব। তাই চিকিৎসা সম্পর্কে ইসলামের গাইড লাইন হলো রোগ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, রোগ অনুযায়ী চিকিৎসা হলেই আল্লাহর হুকুমে আরোগ্য হয় (মুসলিম)। লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য। কো-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.
বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com
অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com
ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১