বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১৮ November ২০১৮

নারী ও শিশুর পথচলা হোক নিরাপদ


চন্দ্রশিলা ছন্দা

নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ কিংবা বিকৃতি, পৈশাচিকতা শব্দগুলো মনুষ্য সমাজের জন্যই প্রযোজ্য। আবার সভ্যতা, অপরাধবোধ শব্দগুলো প্রাণিকুলে শুধু মানুষের বেলায়ই সাজে। পশু সমাজে অপরাধ মারামারি হিংস্রতা হয় না এমন নয়; কিন্তু পশুদের বেলায় যা স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক বলে আমরা ধরে নিতে পারি, মানুষের বেলায় সেভাবে ধরে নেওয়া যায় না বলেই সমাজে যখন অপরাধ বাড়তে থাকে, তখন নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমাজের সচেতন মানুষের আশঙ্কা বাড়তে থাকে। তাই সচেতনতা বৃদ্ধিতে এক হতে হয় প্রতিকারের উদ্দেশ্যে। বর্তমান সময়ে ধর্ষণ তেমনি এক আশঙ্কার শব্দ। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় ধর্ষণের ঘটনা পড়ে বিমর্ষ হতে হচ্ছে আমাদের।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৭৭৬ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু ধর্ষণের ঘটনাই ঘটেছে ৫১৪টি। গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭ জন। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে প্রায় ৬টির বেশি ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য বলছে, চলতি বছরের গত তিন মাসে ৭৯টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন নিপীড়ন সংঘটিত হয়েছে আরো ৬২ শিশুর ওপর। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে ৩ হাজার ৩০০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ওদিকে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতর বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে রাজধানীসহ সারা দেশে বিভিন্নভাবে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১০ হাজার ৩২৪টি। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২৮০ জন নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়েছে। (তথ্যসূত্র : দৈনিক যুগান্তর) আতঙ্কিত হওয়ার জন্য এই তথ্যই যথেষ্ট। পত্রিকায় আসা ঘটনার অন্তরালে আরো কতশত ঘটনা হারিয়ে যাচ্ছে কিংবা সামাজিক ভয় লজ্জা জড়তায় কত ঘটনা নারী এবং আক্রান্ত কিশোরীরা গোপন করে যাচ্ছে, কে জানে!

শারীরিকভাবে ধর্ষিত হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে নারীরা মানসিকতার বিকৃতিতে মনে মনে শতবার ধর্ষিত হন। প্রলোভন দেখিয়ে কোনো অবুঝ শিশুকে ধর্ষণ করলে তাকে শুধু ধর্ষণ বললে ভুল হবে, তা হচ্ছে বিকৃত যৌনাচার। কেউ কেউ মনে করেন পর্নোগ্রাফি, ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট মানুষকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। নেশাজাতীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা ছাড়াও নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদি মানুষকে অমানুষে পরিণত করছে প্রতিনিয়ত। অথচ পৃথিবীতে লাখ লাখ প্রাণীর মধ্যে শুধু মানুষই শ্রেষ্ঠ। মানুষ তার জ্ঞান বুদ্ধি বিবেচনাকে নিখুঁতভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিজ্ঞানে মানুষের অর্জনের কোনো কমতি নেই। অথচ এই মানুষেরই মানসিক বিকৃতি কখনো কখনো মানুষকে পশুর চেয়েও নিম্নস্তরে নামিয়ে দেয়। কামনা-বাসনা, চাওয়া-পাওয়া মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলেও সেই চাওয়া যখন লালসায় পরিণত হয়, তখন তাকে আর স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া যায় না।

আইনের কঠোর প্রয়োগ না হলে অপরাধপ্রবণতা কখনোই হ্রাস পাবে না; বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও কঠোর হতে হবে। অধিক জনসংখ্যা বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। কাজের অভাব, খাদ্যের অভাব, শিক্ষার অভাব মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়। ফলে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়। অর্থ কিংবা ক্ষমতার জোরে অপরাধী অপরাধ করেও সাজা না পেয়ে আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে আসে। কাজেই এ ধরনের অপরাধের জন্য দ্রুত বিচার এবং কঠোর আইনের যথাযথ ব্যবহার খুবই প্রয়োজন। তা না হলে মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ সবকিছুই দ্রুত নষ্ট হতে থাকবে। ধরে রাখা যাবে না সামাজিক বন্ধনের ভিত।

অনেক সময় দেখা যায় একজন নারী ও শিশু নির্যাতনকারী পুরুষকে পরিবারের অন্য সদস্যরাও সহযোগিতা করছে। এটা আরো বেশি দুর্ভাগ্যজনক। পরিবারের আশ্রয় প্রশ্রয়েও অনেক সময় অপরাধীর অপরাধপ্রবণতা বাড়তে পারে। ধর্ষক কারো ভাই, স্বামী, কিংবা সন্তান হলেও তাকে রক্ষা না করে আইনের হাতে তুলে দেওয়া উচিত তাকে। এতে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অনেক সময় কোনো কিশোরী ধর্ষণের শিকার হলে মেয়েটির পরিবার মেয়েটিকে বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করে অথবা আত্মীয়-পরিজনের কাছে মান-সম্মানের কথা ভেবে ঘটনা গোপন করার চেষ্টা করে। কখনো আবার বিভিন্ন চাপে কিংবা দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে টাকা-পয়সা দিয়ে ঘটনা মীমাংসা করে ফেলে। কিন্তু এ প্রবণতা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এভাবে আমরা বুঝে না বুঝে অপরাধীকে সাহায্য করছি। এতে অপরাধীর অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবারগুলোকে বুঝতে হবে ধর্ষণ একটি অপরাধ। যে ধর্ষিত হয়েছে সে নয়, যে ধর্ষণ করেছে সে-ই অপরাধী। তাকে শাস্তির আওতায় আনতেই হবে, সে যে-ই হোক।

সরকার জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করেছে। নারী নির্যাতন রোধে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন-২০১০, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা বিধিমালা-২০১৩, ডিএনএ আইন-২০১৪ এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৩-২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এছাড়া জয় মোবাইল অ্যাপস নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড এবং এটুআই প্রকল্পের আর্থিক সহায়তায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্প লাইন সেন্টার (১০৯) একটি মোবাইল অ্যাপস প্রবর্তন করা হয়েছে। নির্যাতনের শিকার কিংবা নির্যাতনের আশঙ্কা রয়েছে এমন নারী ও শিশুদের তাৎক্ষণিকভাবে সহায়তা প্রদান করার জন্য এই অ্যাপস ব্যবহার করা যাবে। নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্প লাইন সেন্টার (১০৯)-এর মাধ্যমে নিকটস্থ থানা এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় উপ-পুলিশ কমিশনার এবং জেলা পর্যায়ে পুলিশ সুপারের কাছে মেসেজ চলে যাবে। পুলিশ ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার এবং ভিকটিমের আত্মীয়-স্বজন তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন মহিলাবিষয়ক অধিদফতর মাল্টিসেক্টোরাল প্রোগ্রামের আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। হেল্পলাইন সেন্টারের নম্বর ১০৯২১। ১০৯২১ নম্বরে ফোন করে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু প্রয়োজনীয় সব ধরনের সেবা এবং সহায়তা পেতে পারেন। নম্বরটিতে মোবাইল এবং ল্যান্ডফোন থেকে ফোন করা যায়। চব্বিশ ঘণ্টা নম্বরটি খোলা থাকে।

আমাদের দেশে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ২০০৩ সালে যৌন হয়রানিকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই আইনে যৌন হয়রানির শাস্তি সর্বনিম্ন তিন বছর ও সর্বোচ্চ দশ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

দেশে বর্তমানে নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীরা এখন তাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতন। নারীরা সবরকম কাজে অংশগ্রহণ করছে। আইন, মানুষের মূল্যবোধ এবং রাষ্ট্রে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে নারী অগ্রগতির কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং নারীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নারীর পাশে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে অবশ্যই রাষ্ট্রকে। ধর্ষণ সন্ত্রাস প্রতিরোধে পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। দেশের স্কুলগুলোও এ ব্যাপারে ভালো একটি ভূমিকা রাখতে পারে। ধর্ষণ নামের এই ব্যাধির মূলোৎপাটন করতে হলে সমাজের প্রতি স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুত কার্যকর করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই এক্ষেত্রে। 

 

সূত্র : পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১