‘সব্যসাচী’ লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি। সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই ছিল তার বিচরণ। ফলে এই অভিধায় সাহিত্যপাঠকরা অভিষিক্ত করেছিলেন তাকে। আজীবন লেখালেখিকেই জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। জীবনের সহজ এবং চমকপ্রদ একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘জীবন তো এক চলচ্চিত্র! শুরুতে শাদা পর্দা, শেষেও শাদা পর্দা। মাঝখানে ওই ছবিটাই সবকিছু।’ জীবন ছিল তার কাছে এই চলচ্ছবি। এ-জীবন সাধারণ কোনো জীবন নয়, লেখকের জীবন। লিখে গেছেন সাহিত্যের সব শাখায়, এমনকি গান এবং চলচ্চিত্রের ভুবনেও ঢুকে পড়েছিলেন তিনি। তার অনুপস্থিতির শূন্যতা তাই আমাদের সাহিত্যে কখনো পূরণ হওয়ার নয়।
শূন্যতা? শব্দটা লিখেই থমকে যেতে হলো। শূন্যতাও তো জীবনের অনিবার্য আরেকটা দিক। সৈয়দ হকই তো এই শূন্যতা, অনেকটা সার্ত্রীয় সত্তাতাত্ত্বিক ধারণার সঙ্গে মিলে যায় তার ভাবনা : ‘কখনো কখনো মনে হয়, এ জীবন এক শূন্য ক্যানভাস। আমাদের জীবনকাহিনী শূন্যতা পূরণেরই ইতিহাস।’ এরই সূত্র ধরে প্রশ্ন উঠতে পারে, কবি কে? পাবলো নেরুদা এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। আত্মস্মৃতিতে তিনি লিখেছিলেন, কবিকে অবশ্যই আলোর ব্যাখ্যা দিতে হবে। আগে কবি ছিলেন পুরোহিত এখন তিনি ‘সামাজিক কবি’। সৈয়দ শামসুল হকের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি হয়ে উঠেছিল।
মনে পড়ে, কবি হিসেবে চিহ্নিত করা হলে সৈয়দ হক আত্মশ্লাঘা বোধ করতেন। হাইদেগারও বলেছিলেন কবিতাই হচ্ছে সামাজিক ‘চিন্তার কণ্ঠস্বর’। নেরুদাও বলেছিলেন, অস্মিতাকে ছাড়িয়ে কবিকে ‘সামাজিক’ হয়ে উঠতে হয়। সামাজিকতার মর্মেই প্রবিষ্ট থাকে রাজনীতির প্রখর বোধ। তবে এটা ঘটেছে ধীরে ধীরে, অনেকটা আত্মআবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমিত্বকে বাদ দিয়ে কিংবা পাশ কাটিয়ে কী কবিতা রচনা করা সম্ভব? সাহিত্যমাত্রই আমিত্বের বয়ান, সম্প্রতি এই কথাটাই আবার নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন প্রখ্যাত ইতিহাস-তাত্ত্বিক রণজিৎ গুহ তার তিন আমির কথা শীর্ষক গ্রন্থে। সৈয়দ হকের কবিতায় এরই বহুস্বরিক প্রতিফলন লক্ষ করি। শুরু থেকেই প্রেমের তীব্র অনুভব আর রিরংসাজনিত বহুমুখী ভাবনায় আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি। তীব্র ভাষাসচেতনতারও পরিচয় দিয়েছেন হক। মগ্নচেতনাস্রোত, পারম্পর্যহীনতা, স্বয়ংক্রিয় লিখন পদ্ধতি, উল্লম্ফনের চমৎকার চকিত ব্যবহারে তার কবিতাকে, ভ্যালেরি যেমন বলেছেন, সংগীতের প্রতিস্পর্ধী করে তুলেছে।
বৈশাখে রচিত পিক্তমালায় আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণার মধ্যে উঠে এসেছে উত্তর-ঔপনিবেশিক পূর্ববাংলা, যেখানে ‘অনুপম শান্তি সমর্পণে বলতেন পিতা একসাথে থাকিস বাছারা।’ শিকড়চ্যুতি ঘটছে মানুষের। কবি নিজেও তার ‘নীল সুটকেসে’ বহন করে এনেছিলেন ‘কুড়িগ্রাম থেকে ক্রুদ্ধ ধরলার/একটি কল্লোল আর আকন্দের পাতা আর শ্যামলের ছবি।’ রিরংসাজনিত মনোজাগতিক ব্যক্তিসংকট থেকে দেশভাবনায় এবং দেশভাবনা থেকে বৈশ্বিক সংগ্রামী অনুভবে এসে পৌঁছেছিলেন। এভাবেই সম্পূর্ণতা পেয়ে যায় তার কবিতাভাবনার বৃত্তটি। মানবিক ভাবচ্ছবিই মূর্ত হয়ে ওঠে তার যাবতীয় কবিতায়। তার জীবনব্যাপী কবিতাভিযানের বাঁকে বাঁকে বাতিঘরের মতো জ্বলছে বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ : বৈশাখে রচিত পিক্তমালা, পরানের গহীন ভিতর, এক আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি, অস্তিত্ব পথিক আমি, বেজান শহরের জন্যে কোরাস, অমা-চন্দ্রিমার কাল, ভালোবাসার রাতে। ভাবানুষঙ্গ ও বিষয়বৈচিত্র্যে ভরা তার কবিতাবিশ্ব। বািবভূতি আর বিষয়-বিভঙ্গে রূপময়। দু-একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি : [১] কি কামে মানুষ দ্যাখে মানুষের বুকের ভিতরে/নীল এক আসমান — তার তলে যমুনার ঢল,/যখন সে দ্যাখে তার পরানের গহীন শিকড়ে/এমন কঠিন টান আচানক পড়ে সে চঞ্চল?/কিসের সন্ধান করে মানুষের ভিতরে মানুষ? [২] স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই,/জীবনের বিকল্প তবু জীবন;/ জীবন ও স্বাধীনতা আমাদের হোক। [৩] মহিপাল-ধর্মপাল থেকে শেখ মুজিবের কাল—/একটি আকাল আমি দেখেছি কিভাবে/আমার সমস্ত কাল বোধ ব্যাস গ্রাস করে আছে।
‘সেই রচনাই ভালো যা নাটকীয় ভঙ্গিতে লেখা হয়’, কথাটা বলেছিলেন রবার্ট ফ্রস্ট। সৈয়দ হক কবিতায় এই নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই বঙ্গদেশ, বঙ্গদেশের মানুষ আর তার সমকালীন ইতিহাস রক্ত, স্বেদ, সমীপতায় সমর্পিত হয়েছে তার কবিতায়। একালে মহাকাব্যিক বীরগাথা রচিত হয় না। কিন্তু সৈয়দ হকের লিরিকগুলোকে যদি বিচ্ছিন্ন না ভেবে একক সমগ্রতায় দেখা হয়, তাহলে মহাকাব্যেরই মহিমা খুঁজে পাবেন পাঠক।
কবিতায় সবকথা বলা যায়নি বলে জীবনানন্দ দাশ আরেকটি মাধ্যমে কাজ করেছিলেন, সেটা আখ্যানে। সৈয়দ হকও কী এই অভিপ্রায়ে উপন্যাস রচনায় হাত দেননি? কেননা তিনি জানতেন, ‘একা মানুষ কিন্তু একক’ নন। ব্যক্তি-আমিকেই তিনি আমাদের জীবনপ্রবাহের মধ্যে নানা রূপে দেখতে চেয়েছেন বলেই রচনা করেছেন উপন্যাস। কিছুদিন আগে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়া জুলিয়েন বার্নের একটা লেখা পড়ছিলাম, সেখানে লিখেছেন ‘তীব্র মানবিক আবেগ’ প্রকাশের তাড়নাতেই তিনি উপন্যাস রচনা করেন। সৈয়দ হকের উপন্যাসেও এই মানবিক আবেগের বহুমুখী প্রকাশ খুব সহজেই চোখে পড়ে। শুরু হয়েছিল দেয়ালের দেশ ও এক মহিলার ছবির মধ্য দিয়ে; শীর্ষস্পর্শী হয়ে ওঠে গুপ্ত জীবন প্রকাশ্য মৃত্যুতে। কৃষিজীবন থেকে উন্মূলিত মানুষ, নাগরিক নষ্টামি, উত্তর-উপনিবেশবাদী রাষ্ট্র ও জনজীবনের ধারাবাহিক রূপান্তরের ছবি এসব উপন্যাসে উজ্জ্বল। বাঙালি জাতিসত্তাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। সৈয়দ শামসুল হক, আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না যে, মুক্তিযুদ্ধের কাহিনীকার হিসেবে অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। এই সাফল্য শুধু তার আখ্যান নির্মাণের কারুকৃতির জন্যে নয়, অথবা নয় মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বলে। তিনি আমাদের প্রখর ইতিহাস সচেতন, যে-ইতিহাস বিকৃতিতে আবিল হয়ে পড়েনি। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ তার বিভিন্ন উপন্যাসে এপিকতুল্য গ্রন্থনায় বিধৃত। আবার প্রাচ্যন্যারেটিভের প্রথাগত রূপকে যেমন বিনির্মাণ করেছিলেন সেলিম আল-দীন, তেমনি কাব্যনাটকের শক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন সৈয়দ হক।
লেখক শুধু যা ঘটে যায় তার কথাই বিবৃত করেন না। ব্যক্তিমানুষ আর জাতি ভবিষ্যতে কোন পথে অগ্রসর হবে, জাতিরাষ্ট্রের চরিত্র কী দাঁড়াবে, সেসবের ইঙ্গিতও থাকে তার লেখায়। লেখক এভাবেই জাতিকে বিনির্মাণ করেন। তার এই বিনির্মিত পথেই জাতির উত্থান ও স্থিতি। কথাটা বলেছিলেন কিউবা জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা হোসে মার্তি। সৈয়দ শামসুল হককে আমরা এরকম একজন লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছি, যার লেখার মধ্যে সমীকৃত হয়ে আছে আবহমান বঙ্গ আর সমকালের বাংলাদেশ। কী কবিতা, কী উপন্যাস, কী নাটক — প্রসঙ্গ ও ভাষাশৈলীর অনন্য কম্পোজিশনে অসাধারণ তার রচনাবলি। লেখক হিসেবে তার যেমন ছিল প্রণীত জীবন, তেমনি তিনি এই বঙ্গদেশেরই হয়ে উঠেছিলেন প্রধান লেখক। তার লেখক-জীবন তাই সাধারণ জীবন ছিল না, ছিল অস্তিত্বমথিত জীবন। নিজেই এ প্রসঙ্গে বলেছেন : ‘আমাদের জন্ম যদিও অর্থহীন ঘটনা, জীবনের অর্থসন্ধানই তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে জীবনকে। এটাও দেখে উঠি, ওই অর্থসন্ধান বস্তুত এক অর্থকল্পনাই বটে। কল্পনার হস্তপদ নেই, কিন্তু মস্তিষ্ক আছে; সেই মস্তিষ্কবোধটাই বুঝি জীবন। জীবনের অনুভবই জীবন আসলে।