সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ হলেও তাদের ওপর থেকেই যেন আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে রাজনীতিকদের। নিজেদের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সমঝোতার পথ ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত করে ফেলছে রাজনৈতিক দলগুলো। উল্টো পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। নিজেরা আলোচনায় না বসে বিদেশের সরকারগুলোর মনোভাব বদলাতে, তাদের সমর্থন আদায়ের জোর প্রচেষ্টায় নামে দলগুলো। তদবিরের জন্য লবিস্ট নিয়োগের ঘটনাও ঘটে। আর নির্বাচন এলেই বাড়ে এই প্রবণতা। ঘুরেফিরে সেই একই সংস্কৃতি চলমান।
রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও প্রতিপক্ষ বিএনপির মধ্যে এখন চলছে দোষারোপের খেলা। সর্বশেষ জাতিসংঘ কর্মকর্তার সঙ্গে বিএনপি প্রতিনিধিদলের বৈঠক নিয়ে এখন সরগরম মাঠ। আওয়ামী লীগের মতে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে বিএনপি এখন দেশে দেশে নালিশ করে বেড়াচ্ছে। আর বিএনপির ভাষ্য, জাতিসংঘের আমন্ত্রণেই গেছে তাদের প্রতিনিধিদল। সরকারের স্বৈরাচারী আচরণ ও দেশের বাস্তবচিত্র বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরতেই সেখানে যাওয়া। এ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সঙ্কট সৃষ্টি হলে বিদেশ যাওয়াটা দোষের কিছু নয়। তবে, তার আগে দেখতে হবে, সঙ্কটটা দেশের মানুষের নাকি কোনো দল বা গোষ্ঠীর। ঘন ঘন বিদেশিদের টেনে আনলে নিজেদের ঘরে অশান্তি আরো বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়। সবচেয়ে ভালো হয়, ক্ষমতার উৎস জনগণের দ্বারস্থ হওয়া।
দেশের সঙ্কটকালে বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়ার প্রবণতা শুরু হয় ১৯৮৯ সাল থেকে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ‘ব্রতি’র প্রধান নির্বাহী শারমিন মুর্শিদের বাবা খান সরওয়ার মুর্শিদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দেশের সঙ্কট নিরসনের জন্য আহ্বান জানান। এরপর ১৯৯৪ সালে মাগুরার উপনির্বাচন ঘিরে দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়। দাবি ওঠে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের। ওই সময় কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার স্টিফেন নিনিয়ান ঢাকায় আসেন।
রাজপথে আন্দোলনরত আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাসীন বিএনপির মধ্যে দূতিয়ালি করতে ঢাকায় ৩১ দিন অবস্থান করেন তিনি। ২০০৩ সালে ওআইসি মহাসচিব পদে প্রার্থী ছিলেন বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণেই তাকে ভোট না দিতে ড. ওলিউর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল নালিশ করেছিল। ২০০৬ সালে বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মধ্যে সংলাপে ভূমিকা রাখেন জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ ভিনদেশিরা। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে ২০১৩ সালে জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকো ঢাকায় আসেন। তিনি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে দফায় দফায় বৈঠক করান। আসেন ভারত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, তৎকালীন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব সুজাতা সিংহও।
দেশে আবার আসছে নির্বাচন। চলতি বছরের শেষের দিকে এই ভোট হওয়ার কথা। নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন নিয়ে এখন রাজনীতি উত্তপ্ত। ক্ষমতাসীনদের পদত্যাগ চাইছে সরকারবিরোধীরা। আর ক্ষমতাসীনদের সাফ কথা, নির্বাচন হবে এই সরকারের অধীনেই। তবে আকার ছোট হবে। এরই মধ্যে দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা হয়েছে। গুম, খুনসহ নানা রকম ঘটনাও ঘটছে। ‘গায়েবি’ মামলারও অভিযোগ তুলেছে বিএনপি। সব মিলিয়ে সরকারবিরোধীদের দাবি, দেশে চরম সঙ্কট চলছে।
গত এপ্রিল মাসে ভারতীয় কংগ্রেসের সম্মেলন উপলক্ষে দলটির আমন্ত্রণে দিল্লি গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক দুই মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ও দীপু মনি। এর দুই সপ্তাহ পরেই ২২ সদস্যের প্রতিনিধিদল নিয়ে দিল্লি যান দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ওই সময় বিএনপির অভিযোগ ছিল- জনবিচ্ছিন্ন হয়ে অবৈধ সরকারের মন্ত্রীরা দাসখত দিতে ভারত গেছেন। এর কিছুদিন পরই আবার বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল দিল্লি যায়। এরপর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, এলডিপির কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, মুজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীসহ বেশ কয়েকটি দলের নেতারা ভারত যান। এরই মধ্যে সৌদি আরব সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিলের (ইউনিসেফ) আয়োজনে গার্ল সামিটে অংশ নেন তিনি। এর আগে সৌদি আরব যান খালেদা জিয়াও।
এই সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে বিএনপি প্রতিনিধিদলের জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের ঘটনাটি। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মিরোস্লাভ জেনকার সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল। তাতে বাংলাদেশের নির্বাচনে জাতিসংঘকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এ বৈঠক নিয়ে গতকাল শুক্রবার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত কয়েকটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতারা নানা অভিযোগ তুলেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সব আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে এখন অভিযোগ করতে জাতিসংঘে গেছেন বিএনপির কয়েক নেতা। একটি বিষয়ে আমাদের আপত্তি আছে। ওয়াশিংটনে দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লবিংয়ের জন্য বিএনপি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এককালীন ২০ হাজার ডলার, আর প্রতি মাসে ৩৫ হাজার ডলারের বিনিময়ে লবিস্ট নিয়োগ করেছে দলটি। এটা কি তারা পারেন? এটার কি কোনো প্রয়োজন আছে?’
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেন, দেশের জনগণ বিদেশি রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না। কোনো ষড়যন্ত্র সফল হবে না। আজকে আপনারা যাদের প্রভু মানেন, একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা বাংলাদেশকে সমর্থন করেননি। এ সময় অবৈধ পথে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন না দেখে জনগণের ওপর আস্থা রাখুন। বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।
তবে আওয়ামী লীগের সমালোচনাকে দুর্বলতা হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, বিএনপি কোনো নালিশ করতে যায়নি। জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে গেছে। সেখানে এদেশের বাস্তবতা তার দলের নেতারা তুলে ধরেছেন। ঈর্ষান্বিত হয়ে আওয়ামী লীগ সমালোচনা করছে।