২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল। এদিন উচ্চ আদালতের নির্দেশে হাজারীবাগ থেকে ২২২টি ট্যানারি কারখানা স্থানান্তর করা হয় সাভারে। এর আগে সরকার সাভারে শিল্প স্থানান্তরের জন্য ট্যানারি মালিকদের দফায় দফায় তাগাদা দিলেও অনেকেই তা মানছিলেন না। ব্যবসায়ীরা না যাওয়ার কারণ হিসেবে প্রকল্পের কাজ অসম্পূর্ণ থাকার বিষয়ে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের ৪ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো প্রকল্পের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হয়নি। যার মধ্যে অন্যতম সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ এখনো সম্পন্ন না হওয়া কিংবা হস্তান্তর না করা।
ফলে ব্যবসায়ীরা চামড়া কারখানার বৈশ্বিক প্ল্যাটফরম- ‘লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ-এলডব্লিউজি’ এর সনদ নিতে পারছেন না। এতে ব্যাহত হচ্ছে রপ্তানি বাণিজ্য। কারণ এই সনদ না থাকায় জাপান ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামিদামি ব্র্যান্ডগুলোর কাছে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। আর রপ্তানি কম হওয়ায় কোরবানির ঈদসহ প্রতিবছর দেশে বিপুলসংখ্যক পশু জবাই হলেও ট্যানারি মালিকদের চামড়া কেনার চাহিদা থাকে কম। এছাড়া, প্রতিবছরই কিছু না কিছু চামড়া অতিরিক্ত জমা হয়ে থাকে তাদের কাছে। অন্যদিকে, চাহিদার তুলনায় কোরবানিতে চামড়ার পরিমাণ বেশি হওয়ায় কমে যায় কাঁচা চামড়ার দামও। অনেকটা পানির দরেই চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হন বিক্রেতারা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন অনেকেই। এসবের জন্য বিসিককে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) নেতারা। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমাদেরকে সিইটিপি স্থাপন হয়েছে এমন মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৭ সালে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে নিয়ে আসা হয়েছিল। এ কারণে উৎপাদনের যাওয়ার জন্য একটি ট্যানারিও প্রস্তুত ছিল না। এ কারণে গত চার বছরে চামড়াশিল্পে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এজন্য বিসিকের অদক্ষতা, অদূরদর্শিতায় চামড়া শিল্পের আজকের এই পরিণতি। কিন্তু এত প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও আমরা বিভিন্ন মেশিনারিজসহ শিল্প স্থাপনে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি।’
এদিকে, ২০১২ সাল থেকে সিইটিপি স্থাপনের কাজ করছে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যেই সিইটিপি স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছর পর গত মাসে তারা বিসিককে হস্তান্তর করেছে। অন্যদিকে, সিইটিপি ব্যবস্থাপনার জন্য যে সংস্থা গঠন করা হয়েছে তাদের কাছে এখনো দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়নি বিসিক। এ প্রসঙ্গে সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘সংস্থার কাছে সিইটিপি বুঝিয়ে দেওয়ার পর বোঝা যাবে সেখানে কোনো সমস্যা রয়েছে কিনা। কারণ, এলডব্লিউজি সনদ পেতে হলে এটি শতভাগ ত্রুটিমুক্ত থাকতে হবে। এছাড়া সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য এখনো কিছুই করা হয়নি। এই দুটি জিনিসের ওপর নির্ভর করছে আমাদের এলডব্লিউজির সনদ পাওয়ার বিষয়টি।’
ব্যবসায়ীরা জানান, হাজারীবাগে থাকাকালীন অনেক প্রতিষ্ঠানেরই এলডব্লিউজি সনদ ছিল। সাভারে স্থানান্তরের কারণে সেই সনদ অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় তারাও এখন রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়েছেন। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, যে উদ্দেশ্যে হাজারীবাগ থেকে তাদের জোরপূর্বক সাভারে নিয়ে আসা হয়েছে, তার অনেক কিছুই এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
এবিএস ট্যানারির মালিক ইমাম হোসাইন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, যেজন্য আমরা হেমায়েতপুরে এসেছি সেই লক্ষ্য থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে। কবে নাগাদ লক্ষ্য পূরণ হবে জানি না। আর এ কারণে ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আমরা সরাসরি চামড়া কিংবা চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে পারছি না।’
এ প্রসঙ্গে আরাফাত লেদার কমপ্লেক্সের মালিক মোহাম্মদ মনির হোসাইন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমাদেরকে সরকার এতদিন এখানে আনার জন্য নানা প্রচেষ্টা চালিয়েছে সরকার। এখন আমরা চলে এসেছি কিন্তু সরকারের দিক থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। আমাদের দিক থেকে সহযোগিতার কোনো কমতি নেই।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া রপ্তানিতে আয় ছিল ১২৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে তা দাঁড়ায় ৭৩ কোটি ৯৩ লাখ ৯ হাজার মার্কিন ডলারে। অর্থাৎ তিন অর্থবছরের ব্যবধানে চামড়াশিল্পে রপ্তানি আয় প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। যদিও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের শেষ চার মাস করোনার কারণে রপ্তানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। তবে মহামারির মাঝেই ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। তাদের এই প্রচেষ্টার ফলে বিদায়ী অর্থবছরে (২০২০-২১) এ খাতে আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) লক্ষ্যমাত্রার ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ে এ খাত থেকে আয় হয় ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার।
বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে টিকা কার্যক্রম জোরদার হওয়ায় সামনে বাজারের পরিস্থিতি আরও ভালো হবে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। এজন্য সরকার আগামী অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১৩১ কোটি ডলার।
এদিকে, উন্মুক্ত জায়গায় ট্যানারির বর্জ্য ফেলার কারণে হাজারীবাগের মতো সাভারেও মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এক সমীক্ষায়, পার্শ্ববর্তী নদীতে অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরীর শেষ সীমানা পার হয়ে গ্রামের একটি বাজারের পাশেই চামড়া নগরীর বর্জ্যের বিশাল ভাগাড়। এখন বর্ষাকাল হওয়ায় ট্যানারির বর্জ্য বৃষ্টির পানির সাথে একাকার হয়ে বিভিন্ন বাড়িঘরে প্রবেশ করছে। এছাড়া, শুকনো মৌসুমেও এই এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি এই বর্জ্য গিয়ে পড়ে পাশের ধলেশ্বরী নদীতে। এর ফলে নদীর মাছও মারা যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন সেখানকার বাসিন্দারা।