কতদিন সেই ডাকপিয়নের ডাক শুনেন না। ডাকপিয়নের ডাক শুনলেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসা, জানি না কার চিঠি এসেছে। সুসংবাদ এসেছে, নাকি দুঃসংবাদ! চোখের পলকেই দশ-বিশ বছরের মধ্যে ডাকপিয়ন হারিয়ে গেছে। চিঠি নিয়ে আমাদের কতরকম রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাই না আছে! কত সুখের খবর, দুঃখের খবরই না আসত হলুদ খামে করে। চিঠি নিয়ে রচিত হয়েছে কত গান, কত কবিতা। সেই সুকান্তের রানার ছুটেছে, রানার থেকে গ্রামবাংলার পরিচিত গান- চিঠি লিখেছে বউ আমার ভাঙ্গা ভাঙ্গা হাতে/লণ্ঠন জ্বালাইয়া নিভাইয়া চমকে চমকে রাতে/বউয়ের কাজল ধোয়া চোখের পানি লেগে আছে তাতে...
চোখের সামনে থেকে চোখের পলকে চোখের আড়ালে চলে গেল হারিকেন। গ্রামে গ্রামে এখন চলে এসেছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ সাময়িক চলে গেলেও এখন চার্জলাইট, মোমবাতি দিয়ে কাজ সেরে নেওয়া যায়। অথচ, একদিন এই পনেরো-বিশ বছর আগেও সন্ধ্যা হলেই ঘরের সামনে চিমনি পরিষ্কার করতে বসতেন বাড়ির বৌ-ঝি। কিশোর-কিশোরীরা সন্ধ্যা হলেই হারিকেনের আলোয় পড়তে বসত। চোখে যেন আলো না লাগে সে জন্য চিমনিতে কাগজ আটকে রাখত। হারিকেন অন্ধকার দূর করত অল্প একটু, তার চেয়ে বেশি ধারণ করত রহস্যময় একটা আবহ। বৈদ্যুতিক বাতিতে এখন আলো ঝলমলে চারদিক। সেই রহস্য নেই, সেই রোমাঞ্চ নেই।
বাড়িতে বাড়িতে তখন একটা পরিচিত যন্ত্র ছিল। প্রায় সবার ঘরেই, ধনী-গরিব ভেদে কম দামি বা বেশি দামি। জিনিসটি হচ্ছে রেডিও বা ক্যাসেট প্লেয়ার। রেডিও এখন মোবাইলে চলে এসেছে। ক্যাসেট প্লেয়ার হারিয়ে গেছে চিরতরে। ঘরভর্তি ছিল ক্যাসেটে। সেই পুরনো দিনের গান থেকে শুরু করে আধুনিক গান পর্যন্ত। উৎসবে, বিশেষ দিনে কে না একটা দুটা নতুন ক্যাসেট কিনতেন। প্রতি উৎসব উপলক্ষেই বের হতো নতুন নতুন গানের ক্যাসেট। একই ক্যাসেট অনেকে কলম পেন্সিল দিয়ে বারবার টেনে শুনতেন। নির্জন রাতে একটা ছোট্ট ক্যাসেট প্লেয়ার বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে থাকার আনন্দ যে শুনেছে সে-ই জানে। বিশ-বাইশ বছর আগে বিদেশে গেলে অনেকে ক্যাসেটে কথা রেকর্ড করে পাঠাত, গ্রামে উঠানে পরিবার-আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে একসঙ্গে বসে সেই ক্যাসেট শুনত। ক্যাসেট শোনার জন্য দূর-দূরান্তরের আত্মীয়দের খবর দিয়ে আনা হতো। ক্যাসেটে প্রবাসী ছেলের কথা শোনার জন্য বাড়িতে বয়ে যেত উৎসবের আমেজ। সিডি-কম্পিউটার-মোবাইল এসে ক্যাসেট প্লেয়ার খেয়ে ফেলল এক লহমায়।
পালতোলা নাও তো সেই কবে থেকে নেই। যখন থেকে নৌকায় ইঞ্জিন লাগানো হলো পাল গুটিয়ে গেল চিরতরে। নদীতে পালতোলা নাও যিনি দেখেছেন তিনিই জানেন এর সৌন্দর্য। এখন নৌকায় উঠলেই গটগট, ফটফট ইঞ্জিনের শব্দ। গতি বেড়েছে, তার সঙ্গে বেড়েছে বিরক্তিও।
পালকি শেষ কবে দেখেছেন মনে আছে? সম্ভবত আমাদের পিতা-পিতামহদের কাহিনী। এখন এই যে গাড়ি সাজিয়ে বউ নিয়ে যায়, এর মধ্যে কোনো সৌন্দর্য আছে? কিন্তু, কী করবেন? যুগের চাহিদা।
এখন আর এই প্রজন্মটির দেখা মেলে না বললেই চলে, যারা খড়ম পরে হাঁটতেন। মাটিতে হাঁটতে গেলেও শব্দ হতো খটখট। শব্দ শুনেই শিশুরা বুঝতে পারত দাদা কিংবা নানারা হেঁটে আসছেন। এখনকার প্রজন্ম তো বলতেও পারবে না খড়ম কী। খড়ম হচ্ছে কাঠের জুতো। যার কোনো বেল্ট নেই, থাকত সামনের দু’আঙুল আটকে রাখার জন্য শুধু একটা ছোট্ট কাঠের পুঁটলি।
এর সঙ্গে হারিয়ে গেছে বায়োস্কোপ, সার্কাস আর গ্রামের যাত্রাপালাও। রাত জেগে যাত্রা যে দেখেনি সে কেমন করে জানবে বাঙালি সংস্কৃতি কী! গ্রাম থেকে সেই কত দূরে কোন মেলায় যাত্রা হবে। দল বেঁধে যাত্রা দেখতে যাওয়া এবং রাত দুপুরে নির্জন গ্রামের পথ ধরে বাড়ি ফেরা। জীবনানন্দ দাশের মাল্যবান উপন্যাসে আছে তার অসামান্য বর্ণনা।
শেষ হারিয়েছে হাজাম। মুসলমানি করানোর জন্য গ্রামে গ্রামে হাজাম ঘুরতেন। হাজামের কাজ এখন নিয়ে নিয়েছে ডাক্তার। এমন কত কিছুই হারিয়ে গেছে বাঙালি সংস্কৃতি থেকে। মুরব্বিরা তা নিয়ে আফসোস করেন, স্মৃতিকাতরতায় ভোগেন। নতুন প্রজন্মের অনেকে জানেও না এসবের খবর। পালকি, বায়োস্কোপ, খড়ম এসব কিছু- এখন সংগ্রহ আছে জাদুঘরে! হায়, ঐতিহ্যও একদিন জাদুঘরে স্থান পেয়ে যায়!
                                
                                
                                        
                                        
                                        
                                        




