চলতি অর্থবছরে করোনা মহামারীর প্রভাব কাটিয়ে প্রবৃদ্ধির অর্জনের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মালদ্বীপের পরই বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকবে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য। বুধবার ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস-২০২১ : সাউথ এশিয়া ভ্যাকসিনেটস’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক এই ঋণদাতা সংস্থাটি করোনা মহামারীর শুরুর দিকে গত বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে দেওয়া পূর্বাভাস থেকে সরে এসেছে। সংস্থাটির বলেছিল, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি হবে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে সেই অবস্থান থেকে সরে এসে বিশ্বব্যাংক এখন বলছে, প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। একই সাথে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ১ শতাংশ এবং পরের অর্থবছরে (২০২২-২৩) এ দেশে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বিশ্বব্যাংকের সরে আসার বিষয়ে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘করোনা মহামারীর চলমান দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর আগে বাংলাদেশ করোনা ব্যবস্থাপনা এবং টিকা কার্যক্রম জোরদার করার কারণে বিশ্বব্যাংক হয়তো আগের অবস্থান থেকে সরে এসে ইতিবাচক পরিবর্তন করেছে। গত কয়েক মাস ধরে শুধু দেশের অর্থনীতি নয়, টিকার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরে আসতে শুরু করেছিল।’
ড. আতিউর রহমান মনে করছেন, বিশ্বব্যাংকের ধারণার চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে তিনি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যথাযথভাবে মোকাবিলার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘করোনাকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে হবে অন্তত আগামী কয়েকটা সপ্তাহ। সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে করোনা মোকাবিলায় সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে বিশ্বব্যাংকের ধারণার চেয়েও আমরা এগিয়ে যাব।’ বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২১ অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) গড় প্রবৃদ্ধি দাঁড়াতে পারে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। তারপরের ২০২২ অর্থবছরে একটু কমে গড় প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
তবে প্রবৃদ্ধির দিক থেকে মালদ্বীপের ধারেকাছেও নেই দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ অর্থবছর (জানুয়ারি- ডিসেম্বর) শেষে মালদ্বীপের প্রবৃদ্ধি পৌঁছবে ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। সংস্থাটির মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চলতি অর্থবছরে সবচেয়ে ভালো করবে মালদ্বীপ। তারপর বাংলাদেশ। তারপরের অর্থবছরেও সবচেয়ে ভালো করবে মালদ্বীপ, তারপর ভারত এবং তৃতীয় স্থানে চলে যাবে বাংলাদেশ।
ড. আতিউর রহমান দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে সহায়তা প্রদানসহ অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি ত্বরান্বিত করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি বেশ চাঙা। এটাকে আরো জোরদার করতে হবে। সেইসাথে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে আরো সহায়তা দিতে হবে। এসব খাত অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করে।’
তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনার অর্থের বেশিরভাগই দিতে না পারার জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ি করে দ্রুত এসব সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘২০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা দেওয়া ঘোষণা করা হয়েছিলো তার অর্ধেকই দেওয়া যায়নি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। এগুলো সমাধান করতে হবে। কারণ ইউরোপে করোনার প্রকোপ এখনো অনেক বেশি। এ কারণে পোশাক খাতসহ অন্যান্য রপ্তানি খাত অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। ফলে রপ্তানির ওপর ভরসা না করে দেশীয় শিল্প ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিকে ত্বরান্বিত করতে পারলে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ অন্যদের তুলনায় আরো ভালো করবে।’
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে (এপ্রিল থেকে মার্চ) ভারতের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ঋণাত্মক ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে তার পরের ২০২১-২২ অর্থবছরে (এপ্রিল-মার্চ) দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াবে দেশটি। এই অর্থবছরে তাদের প্রবৃদ্ধি হবে ১০ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ছাড়া আফগানিস্তান ২০২১ অর্থবছরে (ডিসেম্ব্বর থেকে ডিসেম্বর) জিডিপির প্রবৃদ্ধি করবে ১ শতাংশ এবং ২০২২ অর্থবছরে করবে ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
পাকিস্তানে ২০২০-২১ অর্থবছরে (জুলাই থেকে জুন) জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ১ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টিং স্কফার বলেন, ‘আমরা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি পুনরায় ভালো করার স্পষ্ট ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি। যদিও করোনা পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই।’ তবে দক্ষিণ এশিয়ায় করোনার টিকা কার্যক্রম আরো জোরদারের পরামর্শ দেন। হার্টিং স্কফার বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে টিকা গুরুত্বপূর্ণ। সামনের দিনগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর টিকার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন এবং এক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে এগোনো উচিত।’
গত এক দশকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। করোনা মহামারীতে কিছুটা হোঁচট খেলেও মহামারীর শুরুর আগের বছর প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আর করোনার মধ্যেও ৫.২৪% প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। অথচ স্বাধীনতার পর প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে ছিল। উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে দেশে দারিদ্র্যের হার কমে গত দুই দশকে অর্ধেকে নেমে আসার পাশাপাশি মাথাপিছু আয় এখন দুই হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। মূলত বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর যাত্রার বিষয়টা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে দেড় দশক আগে। ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের একটি প্রতিবেদন বিশ্বে হইচই ফেলে দেয়। ‘নেক্সট ইলেভেন’ (এন-১১) শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার বিচারে উন্নয়নশীল যে ১১টি দেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেখানে স্থান পায় বাংলাদেশ। অন্য দেশগুলো হলো-মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। এছাড়া ২০১৪ সালে ফরাসি আর্থিক ও বীমা প্রতিষ্ঠান কোফেস ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার (ব্রিকস) পাশাপাশি আরো যে ১০টি উদীয়মান অর্থনীতির দেশের তালিকা প্রকাশ করে সেখানেও বাংলাদেশের নাম উঠে আসে। বাংলাদেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম বলেন, ‘সত্তরের দশকে দেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। বাকি ৮৯ শতাংশই ছিল সরকারি খাতের। কিন্তু নব্বইয়ের শুরুতে সরকারের নীতি-সমর্থনের সুবাদে দেশে বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে ওঠে। ফলে অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান বাড়তে থাকে। বেসরকারি খাতের অবদান বৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনীতিতে নতুন নতুন খাত চালু হয়। কর্মসংস্থানেও গতি বাড়ে।’
গত ৫০ বছরে জিডিপির আকারও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ৪ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। তখন দেশে পণ্য উৎপাদন ও সেবায় এই পরিমাণ মূল্য সংযোজন হতো। সর্বশেষ গত অর্থবছরে স্থিরমূল্যে জিডিপির আকার দাঁড়ায় ১১ লাখ ৬৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ৫০ বছরের ব্যবধানে দেশের অর্থনীতির ক্ষমতা বেড়েছে ২৭১ গুণ। চলতি বাজারমূল্যের হিসাবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতি।