ধর্ম

পোশাকের ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি

  • প্রকাশিত ২১ ডিসেম্বর, ২০২০

মুফতি কাজী সিকান্দার

 

 

ইসলাম পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার নাম। একজন মানুষ, একটি সমাজ ও রাষ্ট্র এবং সমগ্র পৃথিবী পরিচালনার পথ ও পন্থা সবিস্তারে ইসলাম বর্ণনা করেছে। এমন কোনো সমস্যা নেই, যেই সমস্যার সমাধান ইসলামে দেয়নি। এমন কোনো কাজ নেই, যেই কাজের সঠিক পদ্ধতি ইসলাম দেখায়নি। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-৩) অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন ‘তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো।’ সুতরাং একজন মানুষের খাওয়া-পান করা, উঠা-বসা, লেন-দেন, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘর পরিচালনা থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা পর্যন্ত ইসলামের আঙ্গিকেই করতে হবে। এটাই ইসলামের দাবি। এটাই ঈমানের দাবি। এটা মুসলিমের জন্য পালনীয় ও কর্তব্য। মুসলিম হিসেবে আমার পোশাক কী হবে? কেমন হবে? নিশ্চয় তার সঠিক সন্ধান ইসলাম দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আদম সন্তান আমি তোমাদের জন্য পোশাকের ব্যবস্থা করেছি। তোমাদের দেহের যে অংশ প্রকাশ করা দূষণীয় তা ঢাকার জন্য এবং তা সৌন্দর্যেরও উপকরণ। বস্তুত তাকওয়ার যে পোশাক সেটাই উত্তম। এসব আল্লাহর নিদর্শনাবলির অন্যতম। এর উদ্দেশ্য, মানুষ যাতে উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা আ’রাফ, আয়াত-২৬)

‘তোমাদের দেহের যে অংশ প্রকাশ করা দূষণীয় তা ঢাকার জন্য এবং তা সৌন্দর্যেরও উপকরণ’-এ কথা থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয় : একটি বাধ্যগত পোশাক-যা পরিধান করতেই হবে অর্থাৎ যে অঙ্গ ঢাকা ফরজ তা ঢেকে রাখার জন্য পোশাক পরিধান করা। আরেকটি হলো পোশাক সৌন্দর্যের উপকরণ : সৌন্দর্যের কোনো শেষ নেই, এতে বান্দা লাগামহীন হয়ে যাবে। তাই আল্লাহ তারপর বলেন, ‘বস্তুত তাকওয়ার যে পোশাক সেটাই উত্তম’। সুতরাং তাকওয়ার পোশাকই হলো ইসলামের পোশাক।

‘টাইটফিট পোশাক’ ইসলামে নিষিদ্ধ : ইসলামী পোশাক আঁটসাঁট হবে না। এমন পোশাক হবে না, যা পরলে শরীরের সাথে লেপটে থাকে। দৈহিক গঠন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে ওঠে। আবু ইয়াযিদ মুযানী (র.) বলেন, হজরত উমর (রা.) মহিলাদেরকে কাবাতী (মিসরে প্রস্তুতকৃত এক ধরনের সাদা কাপড়) পরতে নিষেধ করতেন। লোকেরা বলল, এই কাপড়ে তো ত্বক দেখা যায় না। তিনি বললেন, ত্বক দেখা না গেলেও দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে ওঠে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদিস নং-২৫২৮৮)

পাতলা পোশাক পরা যাবে না : মুসলমানের পোশাক পাতলা ও মিহি হতে পারবে না। যাতে শরীর দেখা যায় এবং সতর প্রকাশ পায়। পোশাক নির্লজ্জতা ঢাকার জন্য।  তবে ভেতরে কোনো কাপড় থাকলে তার ওপর পাতলা কাপড় বা নেটের কাপড় থাকলে সমস্যা নেই। হজরত আলকামা ইবনে আবু আলকামা তাঁর মা থেকে বর্ণনা করেন, একবার হাফসা বিনতে আব্দুর রহমান তার ফুফু উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.)-এর নিকট আসলেন। তখন তার পরনে ছিল একটি পাতলা ওড়না। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং একটি মোটা ওড়না পরিয়ে দিলেন। (মুয়াত্তা মালক : ২/৯১৩)

বিধর্মীদের পোশাক ইসলামে নিষিদ্ধ : হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, নবী (সা.) আমাকে উসফুর (ছোট ধরনের লাল বর্ণের ফুল গাছ) দ্বারা রাঙানো দুটি কাপড় পরতে দেখে বললেন এগুলো হচ্ছে কাফিরদের পোশাক। এতএব তুমি তা পরিধান করো না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২০৭৭) অন্যত্র আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি অন্য কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে সে তাদেরই দলভুক্ত। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪০২৭) এখন আমাদেরকে দেখতে হবে বর্তমানে বিধর্মীদের পোশাক কেমন? তাদের চালচলন কেমন? তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা যাবে না। সাদৃশ্য বলতে তাদের দেখতে যেমন আমাকেও দেখতে তেমন হওয়াকে সাদৃশ্য বলে। তারা যে পোশাক পরে আমাকেও যদি সেই পোশাকে দেখা যায় তবে তা তাদের সাদৃশ্য হলো। এ সাদৃশ্য গ্রহণ করা যাবে না। তাকওয়ার পোশাক ধারণ করতে হবে মুসলিমকে। কারণ আল্লাহ বলেছেন ‘তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো।’

অহংকারী পোশাক নিষিদ্ধ : পোশাক পরিধান করা হবে প্রয়োজনে। পোশাক পরিধান করা নির্লজ্জতা থেকে মুক্তির জন্য। বর্তমানে পোশাকটিই হয়ে গেছে নির্লজ্জ প্রকাশের মাধ্যম। পোশাকে মানুষের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখার জন্য। এখন যেন পোশাকটিই দোষে পরিণত হয়েছে। পোশাক যেন কাউকে অহংকারী না বানায়। যারা কম দামি পোশাক পরে তাদের হেয় করা বর্তমানে ফ্যাশন হয়েছে। তবে এ অহংকারী পোশাক লাঞ্ছনার কারণ হবে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে সুখ্যাতি ও প্রদর্শনীর পোশাক পরবে আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন। (আবু দাউদ, হাদিস নং-৪০২৫) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অহংকারবশত মাটিতে কাপড় টেনে টেনে চলে আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন তার দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না। (বুখারি, হাদিস নং-৫৭৮৮)

নারী-পুরুষের আছে ভিন্নতা। এ ভিন্নতা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত। আল্লাহতায়ালা ভিন্ন করেই সৃষ্টি করেছেন। এ ভিন্নতা গঠনগত দিক থেকে শুরু করে কাজকর্মে, পোশাক-পরিচ্ছেদে, আচার-ব্যবহারে, এমনকী ইবাদতেও। সুতরাং নারীর জন্য যে পোশাক তা পুরুষের জন্য নয়। পুরুষের জন্য যে পোশাক তা নারীর জন্য নয়। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুল (সা.) সেই সব পুরুষের ওপর লানত করেছেন যারা নারীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। আর সেই নারীর ওপর লানত করেছেন যারা পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। (বুখারি, হাদিস নং- ৩৮৮৫) অন্য হাদিসে এ ব্যাপারটি আরো স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নারীর পোশাক পরিধানকারী পুরুষকে এবং পুরুষের পোশাক পরিধানকারী নারীকে রাসুল (সা.) লানত করেছেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪০৯২)

পোশাকে অপচয় নিষিদ্ধ : অপচয় করা প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ। এটা ইসলামের মর্ম কথা। সামাজিক, বৈজ্ঞানিক ও যুক্তির নিরিখেও এটা বাস্তব সত্য যে, অপচয় করা অতি গর্হিত একটি কাজ। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুর বেশি হলে অপচয় হবে। আর এর জন্য কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা খাও, পান করো, অন্যদের দান করো এবং কাপড় পরিধান করো যে পর্যন্ত অপচয় ও অহংকার না হয়। (নাসায়ী, হাদিস নং-২৫৫৯) ইসলাম খেতে নিষেধ করে না। পরিধান করতে নিষেধ করে না। তুমি ইচ্ছেমতো কর। তবে তোমার খাওয়া-পরায় যেন অপচয় না হয়। অহংকার যেন না আসে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যা মনে চায় খাও, যা মনে চায় পরিধান কর, যে পর্যন্ত দুটি বিষয় না থাকে-অপচয় ও অহংকার।’ (বুখারি, হাদিস নং-১০/১৫২)

নারীদের বাইরে বের হওয়ার পোশাক : মহিলারা সৌন্দর্য পোশাক ও স্বর্ণালংকার পরে বেপর্দাভাবে বের হওয়া যাবে না। যার দ্বারা পরপুরুষ মহিলার দিকে অকৃষ্ট হয়। যার দ্বারা ফেতনা সৃষ্টি হয় এমন পোশাক পরে বের হওয়া ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। ইসলাম ফেতনা সৃষ্টি হওয়ার মূলশক্তির মেরুদণ্ডই ভেঙ্গে গিয়েছে। পুরুষকে বলেছে তোমার চোখ নত করো। মহিলাকে বলেছে তোমার চোখও নত করো। (সুরা নূর, আয়াত-৩১) আল্লাহতায়ালা নারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘নিজ গৃহে অবস্থান করো সাজ-সজ্জার সাথে নিজেদের প্রদর্শন করে বেরিও না। যেমন প্রাচীন জাহেলি যুগে প্রদর্শন করা হতো।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-৩৩) বর্তমানে নারীরা জাহেলি যুগের ন্যায় নির্লজ্জভাবে নিজেদের  সৌন্দর্য প্রদর্শন করেই বের হচ্ছে। ইমাম যাহবী (র.) বলেন, ‘যেসব কর্ম নারীর ওপর লানত করে তা হলো অলংকার ও অকর্ষণীয় পোশাকের সৌন্দর্য প্রকাশ করা। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সুগন্ধি ব্যবহার করা।’ (আল-কাবায়ের পৃষ্ঠা-১০২) নারীরা বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের আপনার কন্যাদের এবং মুমিন নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের মুখের ওপর তাদের চাদর নামিয়ে দেয়।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-৫৯) এতে বুঝা যাচ্ছে মহিলারা যখন বের হবে তখন নিজেদের সব ঢেকে বের হবে। তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করে নয়।

ইসলামী নির্দেশনা মেনে চলার মধ্যেই শান্তি রয়েছে। যা মানবজাতির জন্য সফলতার সর্বোচ্চ সিঁড়ি। উপরে বর্ণিত মতে, পোশাকই হলো ইসলামী পোশাক। এটিই ইসলামী সংস্কৃতি। যার মাধ্যমে ইসলামের পরিচয় মেলে ও মুসলিম হিসেবে পরিচিত করে তোলে। সুতরাং আমাদের উচিৎ হবে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা অনুসরণ করা। বিজাতীয় সংস্কৃতিকে যুক্তির নিরিখে দাঁড় করিয়ে তা ইসলামে প্রবেশ করানোর কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ ইসলাম স্বয়ংসম্পূর্ণ। আল্লাহ আমাদের বুঝার এবং আমল করার তাওফিক দান করুন।

 

লেখক : পরিচালক, ইসলাহ বাংলাদেশ, আশরাফাবাদ, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads