নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিলেও সেগুলো বাস্তবায়নে ধীরগতিতে হতাশ যাত্রীরা। এখনো লক্কড়ঝক্কড় মার্কা নৌ-যানে করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের। নাব্যসংকটে নৌ-যানগুলো চলছে ধীরগতিতে। যাত্রী সেবার মান বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলো এখনো দেখেনি আলোর মুখ।
উপকূলবাসী ও যাত্রীরা অভিযোগ করে বলেন, প্রকল্প একনেকে পাস হয়, কাজও শুরু হয়; কিন্তু নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। আবারো প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়, সময়ও বাড়ে। তারপরও নির্ধারিত বাড়তি সময়ে শেষ হয় না প্রকল্পের কাজ। ফলে বছরের পর বছর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে আমাদের।
যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে উপকূলীয় অঞ্চলের নৌ-চলাচল ব্যবস্থার উন্নতি করতে একটি প্রকল্প নেয় নৌ-অধিদপ্তর। নৌ-চলাচলে সহায়ক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও পরিচালনা, আন্তর্জাতিক কনভেনশনের চাহিদা পূরণসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে ওই বছর ১১ মার্চ ৩৭০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা প্রাক্কলন ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন পায় একনেক বৈঠকে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হলেও তা আর হচ্ছে না।
প্রকল্পের ব্যয়ও প্রথম দফায় বাড়িয়ে ৪৫৫ কোটি ৯৫ লাখ এবং দ্বিতীয় দফায় ৬৮৭ কোটি তিন লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এস্টাবলিস্টমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিন ডিসট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিন নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)-শীর্ষক প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ২৭.৪৬% এবং বাস্তব অগ্রগতি ২৮.৩২%। ফলে এ বছর জুনের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে। এ জন্য প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু এটিই নয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বেশিরভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা গেছে। এ মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্পগুলো নিয়ে গত বৃহস্পতিবার অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়। জানা গেছে, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থার মোট ৫১টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ১৪টির কাজ এখনো ২৫ শতাংশের নিচে রছে। ৫০ শতাংশের নিচে ১০টি এবং ৫১-১০০ শতাংশের নিচে রয়েছে ১৭টি প্রকল্প। শতভাগ কাজ হয়েছে মাত্র ৪টি প্রকল্পের। ৬টির কোনো কাজই হয়নি। ওই ৬টির বেশিরভাগই এক বছরের আগে শুরু করা। এ ছাড়া কিছু প্রকল্প রয়েছে যার ভৌত ও আর্থিক অগ্রগতি একই। এটাকে সংসদীয় কমিটি অযৌক্তিক বলে মনে করছে।
চট্টগ্রামের সঙ্গে নৌ-পথে ঢাকা ও আশুগঞ্জের যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাড়াতে ২০১৬ সালে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ আঞ্চলিক অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন প্রকল্প-১ গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি ২০২৪ সালে শেষ করার কথা ছিল। গত বছর সেপ্টেম্বরে ১৪৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৩ হাজার ৩৩৯ কোটি ৪২ লাখ টাকায় উন্নীত করে একনেক সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দেয়। এ সময় প্রকল্পের মেয়াদও এক বছর বাড়ানো হয়। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের ভৌত কাজ (ডিসেম্বর ২০২০) হয়েছে ১০.৭০ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১ শতাংশ। এ বছরের জুনে শেষ হবে এমন প্রকল্পগুলোর মধ্যে নগরবাড়ী নদীবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ১৮.০১ শতাংশ ও ভৌত অগ্রগতি ২৫.২৫ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে মেয়াদ শেষ হওয়া বিশেষ ধরনের টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ হলেও আর্থিক অগ্রগতি ৪৭.৬৭ শতাংশ। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া ৩৫টি ড্রেজার কেনা প্রকল্পের কাজের আড়াই বছরে শেষ হয়েছে মাত্র ১.৩৪ শতাংশ। এ প্রকল্পে অর্থ ব্যয় হয়েছে ১.২৬ শতাংশ। প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই এবং পুনর্ভবা নদীর নাব্যতা উন্নয়ন প্রকল্পের আর্থিক ও ভৌত কাজ হয়েছে যথাক্রমে ৫.৫৪% ও ৬.৩৪%।
গত ডিসেম্বরে শেষ হওয়া উদ্ধারকারী জলযানের জন্য ইঞ্জিনসহ যন্ত্রাংশ কেনার জন্য নেওয়া প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ১৮.১৭ শতাংশ, ভৌত অগ্রগতি ৪৬.০৮ শতাংশ। আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার নৌ-বন্দর স্থাপন প্রকল্পে আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ৫১.৭৬ শতাংশ। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি চলতি বছর ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। চট্টগ্রাম বন্দরে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে নেওয়া প্রকল্পের আর্থিক ও ভৌত অগ্রগতি ০.২৬%। গত বছর জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটি আগামী বছর জুনে শেষ হওয়ার কথা।
এ ছাড়া ৩৫টি ড্রেজার ও সহায়ক জলযানসহ আনুষঙ্গিক সারঞ্জামাদি সংগ্রহ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ১.২৬%, বাস্তব অগ্রগতি ১.৩২%। বিআইডব্লিউটিরি জন্য দুটি মিডিয়াম ফেরি নির্মাণ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ও বাস্তব অগ্রগতি ৫৭ ও ৫৮ শতাংশ। জুনে এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রকল্পগুলোর মধ্যে মোংলা বন্দরের জন্য সহায়ক জলযান কেনা, মোংলা বন্দরে আধুনিক বর্জ্য ও নিঃসৃত তেল অপসারণ ব্যবস্থাপনা, বন্দরে চ্যানেলের ইনার বারে ড্রেজিং, মাতারবাড়ি পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প, পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া নদীবন্দর আধুনিকীকরণ, ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের কাজ গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ে মধ্যে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো হয়নি।
সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়া ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন কে. এম. জসিমউদ্দিন সরকার বলেন, বাস্তবে কাজ করতে গিয়ে পরে নতুন কিছু কম্পোনেন্ট যুক্ত হয়েছে। নকশা সংশোধনের প্রয়োজনও পড়েছে। তাছাড়া তার আওতাধীন প্রকল্পটি দ্বীপ ও চর অঞ্চলে হওয়ায় বেশি সময় লাগছে বলেও জানান তিনি। এক বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশা করছি এর মধ্যে কাজ কাজ শেষ করতে পারব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. আব্দুস শহীদ বলেন, সরকারের প্রকল্পগুলো বেশিরভাগই আমরা সময়মতো শুরু ও শেষ করতে দেখি না। এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও বার বার নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা তা থাকে না। এতে জনগণ যেমন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়, সরকারের ব্যয়ও বাড়ে। আমাদের মনে হয়ে ডিপিপি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সব খাতেই দুর্বলতা আছে। সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ও তদারকির ঘাটতিও রয়েছে।