নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা। গত ৫ বছরে এ সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। সামাজিক ও আর্থিক প্রতিবন্ধকতার কারণে অধিকাংশ নারী মাদকাসক্তই পাচ্ছেন না যথাযথ চিকিৎসা। এক সময় পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন তারা। আবার এই সুযোগটিই নিচ্ছে মাদক পাচারকারীরা। মাদকাসক্ত নারীদের তারা ব্যবহার করছে মাদক পাচারের কাজে।

এদিকে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কত তা নিয়েও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন পরিসংখ্যান। তবে পরিসংখ্যান ভিন্ন হলেও এই সংখ্যা ৪০ থেকে ৭০ লাখ আর নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ১৩ থেকে ২০ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

মাদকাসক্ত নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হচ্ছে শিক্ষার্থী। এছাড়া গৃহবধূ থেকে শুরু করে সব বয়সি নারীই আছেন এর মধ্যে। বিশেষজ্ঞদের মতে, টিনএজ মেয়েদের মধ্যে মাদকাসক্তির অন্যতম প্রধান কারণ পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক না থাকা, বাবা-মার কাছ থেকে পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া। আবার ছেলে বন্ধুদের সঙ্গও অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তারা। গত ৩১ জানুয়ারি রাজধানীর একটি হাসপাতাল থেকে এক কলেজছাত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। অতিরিক্ত মদ্যপানে তার মৃত্যু হয় বলে তদন্তে উঠে আসে। এ ঘটনায় ৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন নিহতের বাবা। পুলিশ নেহা নামে তার এক বান্ধবীসহ ৪ বন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীসময়ে মামলার অপর আসামি আরাফাতও বিষাক্ত মদ্যপানে মারা যায়। নেহা পুলিশকে জানিয়েছে, স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পরই মূলত সে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পরিবার থেকে। জড়িয়ে পড়ে নানা অসামাজিক কাজে। তার মতো আরো অনেক তরুণ-তরুণীই মাদকে আসক্ত বলে তিনি জানান পুলিশকে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সহকারী পরিচালক (উত্তর) খোরশেদ আলম জানান, তারা এরকম অনেক নারী মাদক পাচারকারীদের আটক করেছেন, যারা খুব ভালো পরিবারের সন্তান। কিন্তু অসৎ সঙ্গসহ নানা কারনে তারা মাদকে জড়িয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরে নেশার টাকা জোগাড় করতে তারা নিজেরাই মাদক পাচারে সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসি’র উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার মতে, দেশে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ হতে পারে তাদের দিয়ে মাদক পাচার করানো। সুকৌশলে আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ীরা নারীদের মধ্যে মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। এতে দুই দিক দিয়ে লাভবান হচ্ছে তারা।

প্রথমত তাদের মাদকের ক্রেতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত মাদকাসক্ত এই নারীদেরই তারা ব্যবহার করতে পারছে মাদক পাচারের কাজে। কারণ নারীদের দিয়ে মাদক পরিবহন পুরুষদের তুলনায় নিরাপদ।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঢাকা আহছানিয়া মিশনে কাজ করছে নারী মাদকাসক্তদের নিয়ে। সংস্থাটির আছে একটি নারী মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। এর স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ইকবাল মাসুদ বলেন,স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাদকে জড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ পারিবারিক অবহেলা। বিশেষ করে তারা বাবা-মা’র কাছ থেকে যথাযথ সময় পায় না। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ বিত্ত মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা বেশি দেখা যায়। 

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিহাব ভালোবেসে বিয়ে করেন এইচএসসি পাস সামিয়াকে (উভয়েরই ছদ্দ নাম)। বিয়ের পর তারা চলে আসেন রাজধানীতে। সীমিত আয়ের শিহাব স্ত্রীকে ভর্তি করে দেন ঢাকার বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছুদিন পর সামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সহপাঠীর হাত ধরে প্রথমে সিগারেট পরে গাঁজা এরপর আসক্ত হন ইয়াবায়। তিন বছর পর ইতি ঘটে তাদের দাম্পত্য জীবনের।

তিন বছর আগে জাতিসংঘের এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশ পুরুষ আর নারী ১৩ শতাংশ। মাদকাসক্ত নারীদের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।

অন্যদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, দেশে ৪০ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে ৪ লাখ নারী। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯১ শতাংশ কিশোর ও তরুণ, ৪৫ শতাংশ বেকার, ৬৫ শতাংশ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এবং ১৫ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত।

আবার বাংলাদেশ মাদকবিরোধী সংস্থা (মানস)-এর এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখ। এর মধ্যে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ১৬ শতাংশ। মানসের ওই পরিসংখ্যানে আরো উল্লেখ করা হয়, ৫ বছর পূর্বে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিল ৫ শতাংশ।

এদিকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২০ দশমিক ৬ শতাংশ।

যে-কোনো বয়সি পুরুষ বা নারী যে-কোনো ধরনের মাদকই গ্রহণ করুক না কেন তার শারীরিক ও মানসিক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে এর ব্যাপকতা আরো বেশি।

বাংলাদেশ পুলিশ হাসপাতালের কনসালট্যান্ট গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. দেলোয়ারা বেগম এ প্রসঙ্গে বলেন, নারীরা যেহেতু সন্তান প্রসব করেন তাই একজন মাদকাসক্ত নারীর এ ক্ষেত্রে তার নিজের ও সন্তানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের নারীদের অনেকেরই অ্যাবরশন হয়ে যায়। আবার অপুষ্ট কিংবা কখনো বিকলাঙ্গ সন্তানও জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা আছে।

রাজধানীর গুলশানে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র বিকন পয়েন্টের কনসালট্যান্ট মো. হানিফ জানান, তাদের এখানে চিকিৎসা নিতে আসা ১০ শতাংশের বেশি নারী। নানান কারণে নারীরা মাদকে ঝুঁকে পড়ছে বলে জানান তিনি। এর মধ্যে পরিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, পরিবারের অবহেলা, সঙ্গ দোষ অন্যতম কারণ। গত কয়েক বছরের তুলনায় নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারী মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণী ও কিশোরী। এমনকি গৃহবধূ ও চাকরিজীবী নারীও আছেন এর মধ্যে। এসব নারীর অধিকাংশই ইয়াবা আসক্ত। এ ছাড়া গাঁজা, ফেনসিডিল ও ঘুমের ওষুধ খেয়েও নেশা করেন অনেকে। আবারো উচ্চবিত্ত অনেক নারীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা ফিগার ঠিক রাখতে নেশা করেন।

শুধু মাদক নয়, নারীদের মধ্যে তামাক সেবনের হারও বাড়ছে বলে জানা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ১৫ বছরে ঊর্ধ্বে ৪৩ শতাংশ মানুষ তামাকে(সিগারেট,বিড়ি,সাদা পাতা, জর্দা) আসক্ত। এর মধ্যে ২৯ শতাংশই নারী।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads