ধর্ম

নববর্ষ উদযাপনে ইসলামের বিধিনিষেধ

  • প্রকাশিত ১ জানুয়ারি, ২০২১

মাহফুজুর রহমান হোসাইনী

 

আজ ইংরেজি নববর্ষ। ২০২১ সালের সূচনা। জানুয়ারির পহেলা দিন আজ। ‘পুরোনো বছরের সব গ্লানি মুছে নতুন উদ্যমে নতুন আনন্দে শুরু হোক নতুন বছর। নতুন বছর তোমার জীবনে বয়ে আনুক নতুন কল্যাণ, অনাবিল আনন্দ।’ আমরা এমনটাই কামনা করে থাকি। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, প্রিয়জনকে এ ধরনের বার্তা পাঠিয়ে থাকি। আবার এমনটিও দেখা যায়-নববর্ষের শুভেচ্ছা না জানালে মন খারাপ হয়। এ নিয়ে অনেক সময় ঝগড়াও বেধে যায় আপনজনদের সাথে। অন্যের ভালো চাওয়া, মঙ্গল কামনা করা; নিঃসন্দেহে ভালোকাজ। তবে এ চাওয়াটা কি একদিনের জন্যই? তাছাড়া নববর্ষ বা নতুন বছর কি আপনার জন্য শান্তি, সফলতা নিয়ে আসতে পারবে? নিজেকে বদলাতে হবে। নিজেকে সত্য ও সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। মিথ্যা, পাপাচার, অন্যায়, জুলুম ধোঁকাবাজি, অশ্লীলতা এসব সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে নিজেকে ইসলামের রঙে রাঙাতে হবে। দুনিয়াতে আপনি নিজেকে যে রঙে সাজাবেন সে অনুযায়ীই ফল পাবেন এবং আখিরাতের জন্যও তা হুবহু গচ্ছিত থাকবে। আপনি ভালো কিছু করলে আপনার জন্য ভালো কিছুই জমা হয়ে থাকবে আর খারাপ করলে খারাপই জমা হয়ে থাকবে। সবকিছুই মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহতায়ালার দরবারে রেকর্ড হচ্ছে। ইরশাদ হয়েছে"অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে। আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।’ (সুরা আল যিলযাল, আয়াত-৭, ৮)

নববর্ষ উদযাপন অমুসলিমদের উৎসব। এর সাথে মুসলিমদের কোনোই সম্পর্ক নেই। ইসলামের সাথে সামান্যতমও যোগসূত্র নেই নববর্ষ উদযাপনের। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এবং অন্যান্য ইসলামিক স্কলারগণের কেউ এটা করেননি বা কোনোরকম সমর্থনও করেননি। সর্বপ্রথম নববর্ষ প্রবর্তন করেন প্রাচীন পারস্যের পরাক্রমশালী সম্রাট জামশিদ খ্রিস্টপূব ৮০০ সালে। পরবর্তীতে ব্যাবিলনের সম্রাট জুলিয়াস সিজার খ্রিস্টপূব ৪৫ সালে ইংরেজি নববর্ষ প্রচলন করেন। উইকিপিডিয়ার সূত্র অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৪৫ সালে যখন জুলিয়াস সিজার নতুন জুলীয় বর্ষপঞ্জি কার্যকর করেছিল, তখন সিনেট বছরের প্রথম দিন হিসাবে ১ জানুয়ারিকে স্থির করে। সেই সময় এই তারিখটি ছিল যারা নাগরিক পদে অধিষ্ঠিত হবেন, তাদের অফিসিয়াল পদ গ্রহণের দিন এবং এটি রোমান সিনেট আহ্বানের জন্য ঐতিহ্যবাহী বাৎসরিক দিবস ছিল। এই নাগরিক নববর্ষটি জুলিয়াস সিজারের পুরো জীবদ্দশায় এবং পূর্ব পশ্চিমে রোমান সাম্রাজ্যজুড়ে কার্যকর ছিল এবং যেখানে জুলীয় বর্ষপঞ্জি ব্যবহার অব্যাহত ছিল।

 

পঞ্চম থেকে দশম শতকের মধ্যে ইংল্যান্ডে অ্যাঙ্গেল, স্যাকসন এবং ভাইকিং আক্রমণের ফলে এই অঞ্চলটিকে কিছু সময়ের জন্য পূর্ব-ইতিহাসে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। খ্রিস্টধর্মের পুনঃপ্রবর্তনটি জুলীয় বর্ষপঞ্জিকে জীবিত করে, তবে এর ব্যবহারটি প্রাথমিকভাবে গির্জার পরিষেবাতে শুরু হয়েছিল। ১০৬৬ সালে দিগ্বিজয়ী উইলিয়াম রাজা হওয়ার পর, তিনি ১ জানুয়ারিকে নাগরিক নববর্ষ হিসাবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার আদেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের পর পহেলা জানুয়ারিতে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। বাংলাদেশে থার্টি ফার্স্ট নাইট ও নববর্ষের ব্যাপক প্রচলন ঘটে ২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতের মিলেনিয়াম বা সহস্রাব্দ পালনের মধ্য দিয়ে।

ইংরেজি নববর্ষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। আমেরিকাতে হয় সবচেয়ে বড় ‘নিউইয়ার পার্টি’-যাতে ৩০ লাখ লোক অংশগ্রহণ করে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে প্রায় ১৫ লাখ লোকের উপস্থিতিতে ৮০ হাজারের মতো আতশবাজি ফুটানো হয়। মেক্সিকোতে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ১২টা ঘণ্টা ধ্বনি বাজানো হয়। প্রতি ঘণ্টা ধ্বনিতে ১টি করে আঙুর খাওয়া হয়, আর মনে করা হয়, যে উদ্দেশ্যে আঙুর খাওয়া হবে সে উদ্দেশ্য পূরণ হবে। ডেনমার্কে আবার কেমন লঙ্কাকান্ড! ডেনিশরা প্রতিবেশীর দরজায় কাঁচের জিনিসপত্র ছুঁড়তে থাকে। যার দরজায় যতবেশি কাঁচ জমা হবে, নতুন বছর তার তত ভালো যাবে। আর কোরিয়ানরা যৌবন হারানোর ভয়ে রাতে ঘুম থেকে বিরত থাকে। তাদের বিশ্বাস বছর শুরুর সময় ঘুমালে চোখের ভ্রু সাদা হয়ে যায়। বাংলাদেশে রাত বারোটা বাজার সাথে সাথে আতশবাজি, নাচ-গান, হই-হুল্লোড়, উন্মত্ততা শুরু হয়। নতুন পোশাক, ভালো খাবার, বিভিন্ন স্পটে ঘুরতে যাওয়া, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ইত্যাদির মধ্যদিয়ে পালিত হয় ইংরেজি নববর্ষ।

আমাদের দেশের নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানগুলো অশ্লীলতার সাথে সম্পৃক্ত। যা শরীয়তবিরোধী। তাছাড়া নববর্ষ উদযাপন মূলত অমুসলিমদের কৃষ্টি-কালচার। তারা তাদের ধর্মীয় অনুভূতি থেকে এটা পালন করে থাকে। নববর্ষ উদযাপন করে অমুসলিমদের অনুসরণ করা মুসলমানদের জন্য বৈধ নয়। ইসলামে তা সম্পূর্ণ হারাম। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তুমি কাফির ও মুনাফিকদের অনুসরণ করো না।’ (সুরা আহজাব, আয়াত-৪৮) হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি বিজাতীদের সাথে সাদৃশ্য রাখে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মিশকাত শরীফ) হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সমপ্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করলো সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ (আহমদ, আবু দাউদ, মিশকাত, হাদিস নং-৪৩৪৭)

বিধর্মীদের অনুসরণ অনুকরণের কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। শরীয়তের নীতিমালা অনুযায়ীই আমাদের জীবনযাপন করতে হবে। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। আল্লাহতায়ালার কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম হলো ইসলাম। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহপাকের কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৯) অন্যত্র আল্লাহপাক বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের দীনকে (ইসলামকে) পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতসমূহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং আমি তোমাদের দীন ইসলামের প্রতি সন্তুষ্ট রইলাম।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত-৩) আল্লাহতায়ালা ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। পূর্বের যত ধর্ম আছে সবগুলোকে বিলুপ্ত করে ইসলামকে আল্লাহপাক মনোনীত করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই আমি তোমাদের নিকট পরিপূর্ণ, উজ্জ্বল ও পরিষ্কার ধর্ম নিয়ে এসেছি। নবী মুসা (আ.) যদি দুনিয়ায় থাকতেন, তাহলে তাঁকেও আমার অনুসরণ করতে হতো।’ (মুসনাদে আহমদ, মিশকাত)

বিশিষ্ট মুফাসসির ইবনে কাসির রহিমাহুল্লাহ বলেন, কোনো মুসলিমের সুযোগ নেই কাফিরদের সামঞ্জস্য গ্রহণ করা, না তাদের ধর্মীয় উৎসবে, না মৌসুমি উৎসবে, না তাদের কোনো ইবাদতে। কারণ আল্লাহতায়ালা এ উম্মাহকে সর্বশেষ নবী দ্বারা সম্মানিত করেছেন, যাকে পরিপূর্ণ ও সর্বব্যাপী দীন দেওয়া হয়েছে। যদি মুসা ইবনে ইমরান জীবিত থাকতেন, যার ওপর তাওরাত নাজিল হয়েছে কিংবা ঈসা ইবনে মারইয়াম জীবিত থাকতেন, যার ওপর ইঞ্জিল নাজিল হয়েছে তারাও ইসলামের অনুসারী হতেন। তাঁরাসহ সব নবী থাকলেও কারো পক্ষে পরিপূর্ণ ও সম্মানিত শরীয়তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকতো না। অতএব মহান নবীর আদর্শ ত্যাগ করে আমাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব এমন জাতির অনুসরণ করা, যারা নিজেরা পথভ্রষ্ট, মানুষকে পথভ্রষ্টকারী ও সঠিক দীন থেকে বিচ্যুত। তারা বিকৃতি, পরিবর্তন ও অপব্যাখ্যা করে আসমানি ওহীর কোনো বৈশিষ্ট্য তাদের দীনে অবশিষ্ট রাখেনি। দ্বিতীয়ত, তাদের ধর্ম রহিত। রহিত ধর্মের অনুসরণ করা হারাম। তার ওপর যত আমল করা হোক আল্লাহ তা গ্রহণ করবেন না। তাদের ধর্ম ও মানব রচিত ধর্মের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আল্লাহ যাকে চান সঠিক পথের সন্ধান দান করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-২/১৪২)

ইংরেজি নববর্ষসহ বাংলা, আরবি কোনো নববর্ষই বিশেষ কোনো দিন নয়। এটা অন্যান্য দিনের মতোই একটা দিন। এতে কোনো ফজিলত-বরকত নেই। সব ধরনের নববর্ষ উদযাপন সম্পূর্ণই হারাম। কোনো ভালো কাজের মাধ্যমেও এটা পালন করা যাবে না। নববর্ষের কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা যাবে না। আমাদের ভাই-বোন, ছেলে-মেয়েরা বিধর্মীদের নববর্ষ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে যেন জাহান্নামের দিকে অগ্রসর না হয়, সেদিকেও শক্ত নজর রাখতে হবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে ও পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’ (সুরা আত-তাহরীম, আয়াত-৬) ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন-‘তোমাদের সবাই রাখাল (অভিভাবক, দায়িত্বশীল) এবং তোমাদের সবাইকে নিজ নিজ রাখালি সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। ইমাম একজন রাখাল এবং তাকে নিজের রাখালি সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। ব্যক্তি তার পরিবারবর্গের রাখাল, স্ত্রী তার স্বামীর ঘর-সংসারের রাখাল এবং খাদেম তার মনিবের সম্পদের রাখাল।’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস নং-২১৩)

 

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন মোমেনশাহী

সহ-সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads