নজরুলকে সাধারণত চিনি উপনিবেশবাদ-বিরোধী বলে, সাম্যবার্তাবাহক মনে করে। নজরুল বিশ্বাস ও যুক্তির বাণীকে প্রতিভার-স্পর্ধায় একীকৃত করেছেন এবং পৌঁছে দিয়েছেন— দায়িত্ব নিয়েছেন। নিজেই পৌঁছে দিয়েছেন সবকিছু। প্রমাণ তাঁর রচনা, বিশেষ করে কবিতা। বোধ করি জেনে গিয়েছিলেন তিনি কথাসাহিত্যে এ মতে চলে না, ওই প্রকরণে তা সম্ভব নয়। তবুও নিজের যে প্রতিকৃতি তিনি কথাসাহিত্যে অঙ্কন করেন তার ক্ষরণ ও ক্ষতি, নিশ্চয়ই তার নিজের ও ব্যাপক অর্থে রূপান্তরমান বিক্ষত সমাজেরই। তার উত্তরণ-পথটিও পেতে চাওয়ার অপার উৎসাহও তাতে বিনির্মিত। তাঁর কমিটমেন্টের জায়গাটি তিনি নিজেই পরিষ্কার করেছেন : ‘যে কালে যে সমাজে জন্মেছি তা আমার দৈব, আমি তা অতিক্রম করতে পেরেছি বলেই কবি।’ প্রতিভার-প্রতিজ্ঞা তো তাই! বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে জন্মে নজরুল নিশ্চিত করে কিছু পাননি, ‘সওগাতে’ যে গল্প পাঠান তা তার মৌলবুদ্ধিক্ষরিত। অতঃপর মোজাফ্ফর আহমদ-স্পৃষ্ট হয়ে পড়লে ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া যান’। খুব দ্রুত বুঝে ফেলেন উপনিবেশ-চক্র নিধনের কর্মযজ্ঞ। আরো গভীরে পৌঁছান, শুধু শাসন বদল নয়, ‘স্বরাজ-টরাজ বুঝি না’ উচ্চারণে। পরিবর্তনশীল সমাজ, বৈষম্যহীনতার বা বিষম সবকিছুর জন্য। এর জন্য ঐক্য আহ্বান। ঐক্যের দায় তিনি গ্রহণ করেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য, নিবিড় ও উদার ঐক্য।
কবির এরূপ দায় বর্তালে তখন কবিতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ওঠে। কবিতার ‘অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকিরণ তাদের সাহায্য করেছে’— এ মত নজরুলের ক্ষেত্রে কী করে সাহায্য করে! অতুল প্রতিভা, প্রতুল যার ঐশ্বর্য আর কল্পনায় অভিজ্ঞতা বা স্বতন্ত্র চিন্তার সারবত্তা— নজরুলে তো প্রখর ও অনিবার্য ছিলই! কিন্তু দায়? সচেতন করার দায়, সজাগ করার দায়, বিভেদ ভুলে ঐক্যের দায়— যেটি নজরুল গ্রহণ করেছেন কবিতায়, দৃঢ়তররূপে— কিন্তু কবিতা তা কীভাবে গ্রহণ করবে, সে সহ্যশক্তি তার কতটুকু? প্রতিভা-প্রণালী অবশ্যই নজরুলে তর্কাতীত, কবিতা তা চায়ও— কিন্তু দ্বিতীয় স্তরের দানে পর্যবসিত হলে সে তো ভীষণ ট্র্যাজেডির হয়ে ওঠে, বিশেষ করে নজরুলের জন্য। কার্যত নজরুলকে সে ট্র্যাজেডিই বরণ করতে হয়। তাই তাঁর কবিতা ‘স্থূল ও চিক্কণ সুর’ মেশানো। তাঁর ‘কবিতা প্রধানত শ্লেষাত্মক এবং বর্তমান কালের সমগ্র পৃথিবীর সমাজব্যবস্থার অন্যায় ও অত্যাচারের মুখোশ বার করে ফেলার জন্য প্রযুক্ত।’ নজরুলের সৃজনশীলতা সেরূপ ট্র্যাজেডিকেই বরণ করেছে। সেটি তার সময়ে, ওই বিরূপ পরিবেশে গ্রহণ করতে হয়েছে। প্রতিভার আশ্চর্য ব্যাপক গভীরতা সত্ত্বেও যে স্বকীয় প্রণোদনা সেখানেই তিনি নিমজ্জিত হতে প্রলুব্ধ হয়ে যান। যে সাহিত্য জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত কিংবা যা জীবনকে অনুসরণ করে তাকেই গ্রহণ করতে তিনি নির্বিচারে সম্মত হন।
নজরুল সাহিত্য করতে গিয়েই বিধৃত সমাজ তাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল। মুসলমানদের সচেতন করানোর জন্য, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য উদ্বোধনের জন্য বিশ শতকের তৃতীয় দশকের গোড়ায় তিনি লিখেছেন ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’ কবিতাংশ। প্রসঙ্গত অনেকাংশে ফিরিয়েও নেন নিজেকে উন্মনা-কথকের ভূমিকা থেকে। মুসলিম-অনুসৃত কিছু কবিতা যেমন ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘মোহর্রম’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘কোরবানি’, ‘কামাল পাশা’ও রচনা করেন। কোনো মুসলিম উগ্রবাদ প্রচার নয়, কিংবা সম্প্রদায়গত উসকানি নয় বা নিজ ধর্মের অনুরাগে নয়— তিনি মুসলমানকুলকে জাগাতে নিজ ধর্ম-সংস্কৃতি-ইতিহাস-পুরাণ-পুরাকথার নিমিত্তে স্বীয় সম্প্রচারে নামেন। অবশ্যই একধরনের স্বাতন্ত্র্যচেতনা, জাতীয়তাবাদী মূল্যবোধে দীপিত করে তিনি পশ্চাৎপদ মুসলমানগণকে সম্মুখে এগোনোর জন্য প্রেরণা জোগান— এসবেরই ভেতর দিয়ে। হিন্দু পুরাণ বা ইতিহাসের মতো মুসলিম পুরাণ বা ইতিহাসকেও প্রেরণাদীপ্ত করার তাগিদ তিনি অনুভব করেন, স্বধর্মের জাগরণের ভেতরে। কোরআন-পুরাণ, বেদ-বাইবেল এক করার আদর্শ নজরুলের। কিন্তু সেটির জন্য নিজ ধর্মের শ্লাঘা যেমন দরকার তেমনি পরধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধা দরকার। পশ্চাৎপদ মুসলমানদের নজরুল সেটিই জানাতে চেয়েছেন। নজরুলের আধুনিকতা বা আধুনিক দৃষ্টিচেতনার সবচেয়ে বড় মূলমন্ত্র ছিল এটি। তুরস্কের কামাল পাশাকে প্রতীকী করে তোলেন তার কবিতায়, তুর্কি খেলাফতের চেতনাকে তিনি গ্রহণ করেন— সে কারণেই। অবশ্য নজরুল এ কারণেই ধর্মব্যবসায়ীদের কোপানলে পড়েন, খণ্ডিত হন— সেটি একশ্রেণির স্বার্থবুদ্ধি থেকে। যেমনটা পূর্ব পাকিস্তানে কিংবা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ফৌজি শাসকদের সময় ঘটেছিল। কিন্তু ক্রমাগত নজরুল সর্বমানকুলের জন্য উজ্জ্বল হয়েছেন, সমান্তরের গরিমা অর্জন করেছেন। আধুনিকতার যে দীপশিখাটি তিনি সর্বমানবের মধ্যে বিচ্ছুরিত করেছেন তা অনন্যতায় ও চিরসত্যে পর্যবসিত হয়ে চলে। এজন্য যে ট্র্যাজেডি তাকে বরণ করতে হয় তাতে কবিতার আপাত অপচয় মনে হলেও বিশ শতকের প্রথম পাদের মানবতার আস্বাদিত কল্পলোক চরম সার্থকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বুদ্ধদেব বসু নজরুলের প্রতিভাকে ‘বালক প্রতিভা’ বলেছেন, কিন্তু তাঁর কবিতাকেও কী তিনি উচ্চস্পর্শী মনে করেননি! রবীন্দ্রযুগে বাংলা কবিতার যে আড়ষ্ট রূপ, অমার্জনীয় ছাপ তা কি নজরুল প্রতিভায় বিশেষ সক্রিয় ও সজল হয়ে ওঠেনি? নজরুলই তো কবিতাকে মানুষের কণ্ঠে এনেছেন, কবিতার হাঁকে মানুষকে মার্চপাস্টে নামিয়েছেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ করেছেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার নির্মিতি দিয়েছেন, জাতীয়তবাদের উদ্গীরণ ঘটিয়েছেন, সমাজ বদলের নিশানায় পরিপ্লুত করেছেন, নারী-পুরুষ এক কাতারে বন্দি করেছেন ইত্যাদি কী নয়! সবকিছুর সংঘটন তো ওই কবিতাকেন্দ্রে, কবিতার ধ্বনিতে, মুক্ত মানুষের স্বপ্নের ধ্বনিরা তো জেগে উঠেছে ওই কবিতায়! বাংলা কবিতায় এমন ঘটনা বস্তুত আগে ঘটেনি, কেউ সে উদাহরণ রাখেনওনি। নজরুল তার সমাজে কবিতার পাঠ তৈরি করলেন, কবিতাকে পৌঁছালেন মানুষের বক্ষে। বাংলা কবিতায় এ এক বিরল আশ্চর্য বললে অত্যুক্তি হয় না। কবিতার ইতিহাসে এটি অভিনব! ৎ
 
                                 
                                 
                                         
                                         
                                         
                                        





