বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা লেখক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী জনপ্রিয় করার পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয় তাকে। তবে জাফর ইকবালকে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করেছেন শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা পাঠকপ্রিয় গল্প এবং উপন্যাসের জন্য। জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ এই মানুষটি পড়াশোনা করেছেন পদার্থবিজ্ঞানে। তার লেখা বেশ কয়েকটি কিশোর উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এ ছাড়া কলাম লেখক হিসেবে বেশ আলোচিত। বাংলাদেশের এমন কোনো পত্রিকা খুঁজে পাওয়া দুরূহ, যেখানে তার লেখা নেই। সহজ ভাষায় লেখা তার কলামগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। কলামগুলোতে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। লিখে যান সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই লেখালেখি করেন জাফর ইকবাল। একাধারে তিনি লিখেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, শিশুতোষ গল্প, ভৌতিক সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, ভ্রমণকাহিনী, নাটক, মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজ্ঞান ও গণিতবিষয়ক বই। তবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ও কিশোর উপন্যাসের জন্য তিনি নবীন প্রজন্মের কাছে অসাধারণ জনপ্রিয় একজন লেখক। ‘কপোট্রনিক ভালোবাসা’ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নিয়ে এই গল্প প্রথম প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। বিদেশি গল্প থেকে চুরি করা হয়েছে এমন মন্তব্য করেছিলেন একজন পাঠক। এর উত্তরে তিনি একই ধরনের লেখা বেশ কয়েকটি বিচিত্রায় প্রকাশ করেছিলেন। আমেরিকায় বসে লেখা তার প্রথম দিককার বিজ্ঞান কল্পকাহিনীগুলো পাঠকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। প্রতিবছর বইমেলায় তার নতুন সায়েন্স ফিকশন বই কেনার জন্য প্রতিনিয়ত পাঠকরা ভিড় জমায়। তিনি বাংলা একাডেমি, ইউরো শিশুসাহিত্য পদক, আমেরিকা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।
সফল এই শিক্ষাবিদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫২ সালে সিলেটে। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ। মা আয়েশা আখতার খাতুন। তিনিও লেখালেখি করেন। বড় ভাই প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। আর ছোট ভাই আহসান হাবীব রম্য ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’-এর সম্পাদক, লেখক ও কার্টুনিস্ট। তার স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৬৮ সালে এসএসসি ও ১৯৭০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক সম্মান পাস করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন ১৯৭৪ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন থেকে পিএইচডি করেন ১৯৮২ সালে। বিষয় ছিল ‘চধৎরঃু ারড়ষধঃরড়হ রহ ঐুফৎড়মবহ অঃড়স’। তিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে সাফল্যের সঙ্গে ডক্টরেট-উত্তর গবেষণা সম্পন্ন করেন। আজীবনের মেধাবী জাফর ইকবাল কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৮৮ সালে বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ (বেলকোর) গবেষক হিসেবে। কিন্তু বিদেশের চাকরি ছেড়ে দেশকে ভালোবেসে ১৯৯৪ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। ২৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনের পরিসমাপ্তি শেষে অবসর ছুটিতে যান ২০১৮ সালে অক্টোবরে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অনলাইনে আবেদন করার পদ্ধতির প্রচলন করে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভোগান্তি কমিয়েছেন। গণিত অলিম্পিয়াড সূচনা করে দেশের শিক্ষার্থীদের গণিতের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছেন। তার ‘নিউরনে অনুরণন’ ও ‘নিউরনে আবারও অনুরণন’ গণিতবিষয়ক বই দুটি খুবই জনপ্রিয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাঠ্যবই সংশোধনী কমিটির নেতৃত্বেও আছেন। সেমিস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে তারই হাত ধরে। এছাড়া তিনি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালুর উদ্দেশ্যেও কাজ করে যাচ্ছেন।
কিন্তু দেশের শিক্ষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদান রাখার পরও দেশের একটি শ্রেণির কাছে শত্রু হয়েছেন তিনি। খুবই সহজ কারণ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির একজন বীর যোদ্ধা জাফর ইকবাল। আজীবন লেখালেখি করেছেন মুক্তিযুদ্ধের ওপর। যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচারের দাবিতে সবসময় সোচ্চার। তিনি স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সরাসরি মত প্রকাশ করেন বলে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়।
বাংলাদেশের শিশু-কিশোর ও শিক্ষার্থীদের নির্বিশেষে সবার কাছে জাফর ইকবাল স্যারের নামটি এক নিঃশর্ত অনুপ্রেরণার নাম। তরুণ প্রজন্মের কাছে একগুচ্ছ আশার আলো, একগুচ্ছ স্বপ্ন। মৌলবাদীদের চোখ রাঙানির পরেও তরুণদের হয়ে আন্দোলন করেছেন, নেমেছেন রাজপথে। সেই স্বপ্নবান মানুষটির ওপর নেমে এসেছে ঘাতকের ছুরির আঘাত। বার বার দেশের ওপর হতাশ হয়ে পড়লেও এই দেশ ও দেশের মানুষকে ছেড়ে বিদেশে যাওয়ার কথা একবারের জন্যও চিন্তা করেননি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি আমৃত্যু অবদান রেখে যাবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বহু বছর তিনি বেঁচে থাকুন আমাদের ভালোবাসায় ও শ্রদ্ধায়।