শেষের পথে বহুল প্রত্যাশিত চার মেগা প্রকল্পের কাজ। এগুলো হলো, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও কর্ণফুলী টানেল। এর মধ্যে আগামী জুনে উদ্বোধন হবে স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন হবে আগামী অক্টোবরে। আর ডিসেম্বরে চালু হবে ঢাকাবাসীর কাঙ্ক্ষিত মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই চার প্রকল্প প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি ৯ লাখ টাকার ব্যয় সংবলিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অনুমোদন দেওয়া হয়। চলতি বছর উদ্বোধন হতে চলা চার প্রকল্প থেকে বরাদ্দের বড় আকারের অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। সংশোধিত এডিপিতে (আরএডিপি) সাশ্রয় হবে প্রায় ২ হাজার ২৮১ কোটি টাকা।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাশ্রয় হচ্ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১ হাজার ১ কোটি টাকা। এছাড়া মেট্রোরেল প্রকল্পে ৮০০, কর্ণফুলী টানেলে ৩১৭ ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে এডিপি সাশ্রয় হবে ১৬৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরই পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেল নির্মাণকাজ শেষ হবে। তবে এসময়ের মধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেলের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হবে না। ফলে এডিপিতে সাশ্রয় হওয়া অর্থ পরবর্তী অর্থবছর অন্য প্রকল্পে ব্যয় হবে। এক্ষেত্রে সেতু বিভাগের দুটি প্রকল্পের সাশ্রয় হওয়া টাকা অন্য প্রকল্পে স্থানান্তর হতে পারে। এছাড়া অন্য কোনো মন্ত্রণালয় এডিপির টাকা সাশ্রয় করলে তা-ও অন্য মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করা হবে।
এদিকে চলতি অর্থবছর এডিপি থেকে আরএডিপিতে (সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস রয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আরএডিপি চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে পারে। রাজধানীর শেরে-বাংলা নগরে পরিকল্পনা কমিশনের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এনইসি সভায় প্রস্তাবিত আরএডিপির অনুমোদন দেওয়া হবে। সে লক্ষ্যে কাজ করছে পরিকল্পনা কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কৃষি, শিল্প ও সমন্বয় উইং) মো. ছায়েদুজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু-কর্ণফুলী টানেলসহ নানা প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ সাশ্রয় হচ্ছে। এসব বরাদ্দের অর্থ অসম্পন্ন অন্য প্রকল্পে স্থানান্তর করা হয়। কারণ এক মন্ত্রণালয়-বিভাগের একাধিক প্রকল্প থাকে। যেমন- সেতু বিভাগে শুধু পদ্মা সেতু নয়, আরো একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সুতরাং পদ্মা সেতুর বরাদ্দ সাশ্রয়ের টাকা অন্য প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হবে।
তিনি জানান, সাধারণত মন্ত্রণালয়ভিত্তিক অর্থ বরাদ্দ দেয় হয়। যদি দেখা যায়, কোনো মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বরাদ্দের অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে তখন একই সঙ্গে কোনো মন্ত্রণালয়ের চাহিদা বেশি সেটি দেখা হয়। সে অনুযায়ী বেশি চাহিদাসম্পন্ন মন্ত্রণালয়ে সাশ্রয় হওয়া অর্থ স্থানান্তর হয়। এছাড়া কোনো প্রকল্পে বরাদ্দ কমলে সরকারি ব্যয়ের চাপও কমে আসে।
জানা গেছে, পদ্মা বহুমুখী সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন ও ট্রেন যাবে নিচতলা দিয়ে। মূল সেতুর (শুধু নদীর অংশ) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। মূল সেতু থেকে মাটি পর্যন্ত সংযোগ ঘটাতে তৈরি হয়েছে উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট)। দুই প্রান্তে ভায়াডাক্ট ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার। পদ্মা নদীর ওপর দীর্ঘ এ স্বপ্নের সেতু নির্মাণ প্রকল্পে এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। তবে সংশোধিত এডিপিতে মোট অর্থ চাওয়া হয়েছে ২ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। ফলে এডিপি থেকে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমছে ১ হাজার ১ কোটি টাকা।
এছাড়া উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল লাইনের দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে বেশির ভাগ উড়ালপথ নির্মিত হয়েছে। এ পথে মোট ১৬টি স্টেশন থাকবে। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) এই ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি থাকবে ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। প্রকল্প সূত্র বলছে, মেট্রোরেল চালু হলে মাত্র ৩৫ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিলে পৌঁছানো যাবে। ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে (মেট্রোরেল) ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে সংশোধিত এডিপিতে চাওয়া হয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। ফলে এ মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কমছে ৮০০ কোটি টাকা। তবে এ প্রকল্পের কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের টিউব স্থাপনের কাজও পুরোপুরি শেষ পর্যায়ে। সুড়ঙ্গটি কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করবে। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হবে। টানেলের মোট দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। নির্মাণসম্পন্ন হলে এটিই হবে দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ।
প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ প্রকল্পটি চলতি বছরই উদ্বোধন করা হবে। ২০২১-২২ অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। এখান থেকে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। ফলে এ প্রকল্পে বরাদ্দ কমছে ৩১৭ কোটি টাকা।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কমেছে ১৬৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। নগরীর যানজট নিরসনে জাদুরকাঠি হিসেবে কাজ করবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (উড়াল সড়ক)। দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে প্রকল্পের কাজ। যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত চার লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল লেনের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলা থেকে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত দৈর্ঘ্য সাড়ে ১১ কিলোমিটার। এ অংশটি চলতি বছরের ডিসেম্বরে খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষের।
প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হলে বিমানবন্দর থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিটেই পাড়ি দেওয়া যাবে যাত্রাবাড়ী। চলতি অর্থবছর এ প্রকল্পের আওতায় মোট এডিপি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ৫৬৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ৪০০ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ফলে প্রকল্পটিতে বরাদ্দ কমছে ১৬৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।