এ বছর পাটের উৎপাদন কম হওয়ায়, সংকটে রয়েছেন পাটকল মালিকরা। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি পাটকল মালিকরা এক বছরের জন্য কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ বা অতিরিক্ত শুল্কারোপের পরামর্শ দিয়েছেন। চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ১০ লাখ বেল কম হওয়ায় সরকারকে এ পরামর্শ দিয়েছেন তারা। যদি এটি করা না হয় তাহলে মহাসংকটে পড়বে এ খাতটি। একই সঙ্গে ঝুঁকিতে পড়বে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান।
তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিচ্ছেন না দেশের কাঁচা পাট রপ্তানিকারকরা। পক্ষান্তরে এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে এখনো নির্বিকার বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিলাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডব, বন্যা ও করোনার প্রভাবে এ বছর পাটের উৎপাদন কম হয়। বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশেনের সেক্রেটারি জেনারেল এ বারিক খান বলেন, বিভিন্ন কারণে এ বছর পাটের উৎপাদন কম। বছরের শুরুতে শিলাবৃষ্টির ফলে ফরিদপুর এলাকার পাট নষ্ট হয়েছে। এরপর আসে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। আম্পানের তাণ্ডবে পাট মাটিতে নুইয়ে পড়েছিল। এরপরই আসে বন্যা। পানিতে ডুবে যায় পাট। ফলে যতটা লম্বা হওয়ার কথা ছিল, এ বছর পাট ততটা লম্বা হতে পারেনি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনার ছোবল। করোনার কারণে ঠিক সময়ে শ্রমিক পাওয়া যায়নি। এসব কারণে এ বছর পাটের উৎপাদন কমেছে।
বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) ও বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) বলেছে, দেশে বিদ্যমান পাটকলের সংখ্যা ২৫৯টি। এই পাটকলগুলো পরিচালনায় বছরে প্রয়োজন হয় ৬০ লাখ বেল কাঁচা পাট। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন কাজে আরো পাঁচ লাখ বেল পাটের প্রয়োজন হয়। সব মিলিয়ে বছরে দেশের চাহিদা ৬৫ লাখ বেল। এবার প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে পাটের উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবছর ৭৫ লাখ বেল পাট উৎপাদন হলেও এ বছর হয়েছে মাত্র ৫৫ লাখ বেলের মতো। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ১০ লাখ বেল কম হওয়ার কারণে কাঁচা পাট রপ্তানি হলে এই শিল্প সংকটে পড়বে। উল্লেখ্য, প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ লাখ বেল কাঁচা পাট বিদেশে, বিশেষ করে ভারতে রপ্তানি হয়।
পাট রপ্তানিকারক এম এ কাইয়ুম বলেন, পাটের উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদা বেশি। এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। এ বছর পাটের উৎপাদন কম হলেও তা চাহিদার তুলনায় কম নয়। তাই এমন অবস্থায় কাঁচাপাট রপ্তানি বন্ধ করা ঠিক হবে না। এটি করলে বা রপ্তানি নিরুৎসাহিত করতে অতিরিক্ত শুল্কারোপ করলে সরকার বৈদেশিক আয় হারাবে। এদিকে কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ হবে, নাকি হবে না, এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। পাটশিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতি টন কাঁচা পাট রপ্তানির ওপর ২৫০ ডলার অতিরিক্ত রপ্তানি শুল্ক আরোপের বিষয়েও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি মন্ত্রণালয়।
কাঁচা পাটের বড় বাজার ফরিদপুর ও পাবনায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শুক্রবার খুচরা বাজারে প্রতি মণ কাঁচা পাট বিক্রি হয়েছে দুই হাজার ৮০০ টাকা দরে- যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। অতীতে কখনো কাঁচা পাটের মণ দুই হাজার ৫০০ টাকার বেশি হয়নি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাঁচা পাটের দাম বেশি পড়ায় উৎপাদিত পাটপণ্যের খরচও বাড়বে। যা দিয়ে পাটপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হবে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবিলম্বে এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে পাটশিল্প।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কৃষকরা এ বছর পাটের ভালো দাম পাচ্ছেন, যা ইতিবাচক। এতে তারা ভবিষ্যতে পাটচাষে আরো আগ্রহী হবেন। অপরদিকে উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদামতো দেশের পাটকলগুলোয় পাটের সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাঁচা পাটের রপ্তানি নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। এর জন্য অতিরিক্ত রপ্তানি শুল্কারোপের বিষয়টি সরকার বিবেচনায় নিতে পারে। এতে দেশের পাটশিল্প খাত উপকৃত হবে। বিজেএসএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহিদ মিয়া বলেন, এ বছর কাঁচা পাট রপ্তানি করা হলে দেশের পাটশিল্প মহা সংকটে পড়বে। পাটশিল্প বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কাও রয়েছে। এক মণ কাঁচা পাট রপ্তানি করে যে দাম পাওয়া যাবে, সে ক্ষেত্রে সমপরিমাণ পাট প্রক্রিয়াজাত করে পণ্য রপ্তানি করলে ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেশি দাম পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধের বিষয়ে বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের দাবির বিষয়টি শুনেছি। আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছি। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও পরামর্শ করতে হবে। পাটশিল্প সশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে এই খাতে কর্মরত আছেন দেশের প্রায় দুই লাখ শ্রমিক।
 
                                 
                                 
                                         
                                         
                                         
                                        





