বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনাভাইরাসের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি প্রিয় গোলাপও। গোলাপের উৎপাদন এবং চাহিদায় পড়েছে ভাটা। সম্প্রতি সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের গোলাপ চাষিসহ দেশের অন্যান্য স্থানের ফুল চাষিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কমবেশি গোলাপ ফুলের চাহিদা থাকলেও, গোলাপসহ অন্যান্য ফুলের সব থেকে বেশি চাহিদা থাকে ভালোবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন, ২১ ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস এবং স্বাধীনতা দিবসে।
গোলাপ চাষিরা জানান, লকডাউনের সময়ে কাজের লোকের অভাবে তারা ঠিকমতো বাগানের পরিচর্যা করতে পারেননি। পাশাপাশি সে সময় সবকিছু বন্ধ থাকায় গোলাপ ফুলের চাহিদাও ছিল না। এ সময় অনেক বাগানে ফুল ফুটে আবার গাছেই পচে গিয়েছে। এতে বাগানে গোলাপ গাছের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে অন্যান্য বছরের তুলনায় গোলাপের উৎপাদন কম। চাষিরা আরো জানান, সারা বছরের মধ্যে গোলাপের চাহিদা সব থেকে বেশি থাকে ভালোবাসা দিবসে। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস শুরু হলেই ব্যবসায়ীরা গোলাপ চাষিদের ফুল কেনার জন্য আগাম অর্ডার দিতেন। অনেক সময় ফুল কেনার জন্য অগ্রিম টাকাও দিতেন ফুল ব্যবসায়ীরা। তবে এবার ব্যবসায়ীদের ফুল কেনায় আগ্রহের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
প্রায় ২৫ বছর থেকে গোলাপ চাষের সঙ্গে জড়িত সাভার বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাপুর গ্রামের শাহাজাহান মিয়া। তিনি বলেন, করোনায় কাজের লোকের অভাবে গোলাপের বাগান ঠিক মতো যত্ন নিতে পারিনি। যত্নের অভাবে গোলাপের ক্ষেত নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই এবছর গোলাপের উৎপাদন কম। অন্যান্য বছর ভালোবাসা দিবসের আগেই গোলাপের অনেক ব্যাপারী আমাদের কাছ থেকে গোলাপ কেনার জন্য তোষামোদ করতেন। কিন্তু এবছর ব্যাপারীরা আমাদের কাছে এখনো গোলাপ কেনার জন্য আসছে না। তিনি বলেন, এবছর গোলাপের দাম কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্যান্য বছর ভালোবাসা দিবসের সময়ে গোলাপের দাম অনেক বেশি থাকতো। এবার চাহিদা না থাকায় গোলাপের দামও অনেক কমে গেছে। সামনে আর মাত্র দুই একদিন বাকি আছে, এরমধ্যে গোলাপের দাম না বাড়লে আমাদের অনেক লোকসান হবে।
শ্যামপুর গ্রামের গোলাপ চাষি আবুল হোসেন জানান, ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে এবছর গোলাপের উৎপাদন কম। করোনার কারণে গোলাপের বাজারে গ্রাহকও কম, তাই গোলাপের দামও কম। ভালোবাসা দিবস এবং ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে যদি গোলাপের দাম আর না বাড়ে তাহলে এবছর আমাদের অনেক টাকা লোকসান হবে। আর যদি গোলাপের দাম বাড়ে তাহলে হয়তো কিছুটা লাভের মুখ দেখতে পাবো।
শ্যামপুর গ্রামের আরেকজন গোলাপ চাষি মনির হোসেন। গত ১১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে তিনি স্থানীয় গোলাপের বাজারে আট হাজার টাকার গোলাপ বিক্রি করেছেন।
এবছর গোলাপের দাম কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বাজারে তিনশত পিসে এক বান্ডিল গোলাপ এক হাজার ৭০০ টাকা থেকে দুই হাজার ১০০ টাকা (তিনশত পিস) দামে বিক্রি হইছে। গতবছর ভালোবাসা দিবসের আগে তিন হাজার টাকায় এক বান্ডিল গোলাপ বিক্রি হয়েছিল বলেও জানান তিনি।
গোলাপ চাষিরা আশা করছেন শিগগিরই দেশ থেকে করোনা বিদায় হবে। সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং স্কুল-কলেজ আবারো শুরু হলে গোলাপের চাহিদাও বাড়বে, চাহিদার সঙ্গে বাড়বে গোলাপের দামও।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯০ সালের দিকে সাবেদ আলী নামে এক ব্যক্তি বিরুলিয়ার সাদুল্লাপুরে ফুল চাষ শুরু করেন। তখন ফুলের ফলন ভালো এবং অনেক লাভ হওয়ায়, পরবর্তীতে এ অঞ্চলে গোলাপ চাষের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
সাবেদ আলীর দেখানো পথে ধরে এলাকার কৃষক এবং বেকার যুবকরা গোলাপ চাষের সঙ্গে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে বিরুলিয়া ইউনিয়নের অন্যান্য গ্রামগুলোতেও গোলাপের চাষ বাড়তে থাকে। এভাবেই গোলাপ চাষের মাধ্যমে এলাকার মানুষের ভাগ্য দ্রুত বদলে যেতে থাকে। এখন এ অঞ্চলের প্রায় ৯০ শতাংশ বাসিন্দা গোলাপ চাষের সঙ্গে জড়িত। গোলাপ ফুল চাষের ফলে এই অঞ্চলের মানুষের অভাব অনটন যেমন ঘুচেছে, তেমনি মানুষের মুখে ফুটেছে হাসি।
বিরুলিয়া ইউনিয়ন এখন সবার কাছে পরিচিত গোলাপ গ্রাম নামে। সাদুল্লাহপুর, শ্যামপুর, আকরান, কমলাপুর, মোস্তাপাড়া ভাটুলিয়া, বাগ্মী বাড়ি গ্রামে এখন ব্যাপকহারে গোলাপের চাষ হয়। গ্রাম্য পথের দুই ধারে সারি সারি গোলাপ গাছ। মনে হয় সমগ্র এলাকাই যেন সাজানো হয়েছে টকটকে লাল গোলাপের ফুলে। ফলে পুরো এলাকাই যেন একটা বাগানে পরিণত হয়েছে, যার নাম হচ্ছে ‘গোলাপ গ্রাম’।