যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বাসভাড়া আদায় করেও লাভের মুখ দেখতে পান না বেসরকারি বাস-মালিকরা। কিন্তু কম ভাড়া নিয়ে এবং যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধি করে লাভের মুখ দেখছে সদ্য চালু হওয়া ঢাকা নগর পরিবহন।
রাজধানীতে ওয়ে বিলের মারপ্যাঁচে ফেলে যাত্রীদের কাছ থেকে কিলোমিটারপ্রতি ৪ টাকা বা তার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা বেসরকারি বাসের মালিকরা নানা সময় দাবি করেন, এই ভাড়ায় তাদের পোষায় না। অথচ সরকারি ভাড়ার হার মেনে কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ৫ পয়সা নেওয়া ঢাকা নগর পরিবহন ঠিকই মুনাফা করছে।
কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে চিটাগং রুট পর্যন্ত চলা ৫০টি বাসে এখন দিনে ভাড়া আড়াই লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রতিটি বাসে ভাড়া আসছে ৫ হাজার টাকার মতো। এই ভাড়া দিনকে দিন বাড়ছে। ফলে আগামীতে আরো বেশি ভাড়া পাওয়ার আশা করছেন কর্মকর্তারা।
নগরবাসীকে ঠকিয়ে বাস কোম্পানিগুলো বাড়তি ভাড়ায় নিম্নমানের সেবা দিয়ে যখন অতিষ্ঠ করে তুলেছে, সেই সময় রাজধানীর বাস সেবা পাল্টে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় ঢাকা নগর পরিবহন। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর চালু হওয়া এই বাস দেখাচ্ছে নগরীর অন্যান্য রুটে যাত্রীরা কীভাবে ঠকছে।
সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, একজন যাত্রী উঠলেই মিনিবাসে ৮ টাকা আর বড় বাসে ১০ টাকা ভাড়া হবে। এই ভাড়া সাড়ে চার কিলোমিটার পর্যন্ত। এরপর প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়ার কথা ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসেবে, কিন্তু নগরীতে চলা বাসগুলো কিলোমিটারের এই হিসাব বাদ দিয়ে কিছুদূর পরপর একটি স্টপেজ তৈরি করেছে। প্রতিটি স্টপেজে একটি কাগজে যাত্রীর সংখ্যা লিখে দেওয়া হয়, যে কাগজকে বলা হয় ওয়ে বিল। এ বিল করার পর একটি স্টপেজ পার হলে যাত্রী আর যত দূরই যান না কেন, তাকে পরিশোধ করতে হয় পরের ওয়ে বিলের পুরোটা ভাড়া। এ কারণে বিশেষ করে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের বাস ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি কখনো ৪ টাকা, কখনো ৫ টাকা, কখনো ৬ টাকা পড়ে যায়।
বিপরীতে ঢাকা নগর পরিবহনে সরকারের নিয়ম মেনে ভাড়া আদায় করা হয়। সেখানে ১০ টাকা পর্যন্ত দূরত্বের পর প্রতি কিলোমিটার হিসেবেই ভাড়া কাটা হয়। ওয়ে বিলে ভাড়া যেখানে ১০, ২০ বা ৩০ টাকা হয়, সেখানে ঢাকা নগর পরিবহনে ভাড়া ১২, ১৩, ১৭, ১৯, ২২, ২৬ টাকা হয়ে থাকে। আবার ঢাকা নগর পরিবহনের বাসগুলোতে আসনসংখ্যাও রাজধানীতে চলা অন্যান্য বাসের তুলনায় কম। বাসে সরকার নির্ধারিত আসনের বাইরে কোনো আসন থাকে না। অন্যদিকে রাজধানীতে চলাচল করা প্রায় প্রতিটি বাসেই নির্ধারিত আসনের বেশি বসানোর কারণে যাত্রীরা আরাম করে বসতে পারেন না। এভাবে যাত্রীর কাছ থেকে কম ভাড়া নিয়েও নগর পরিবহনগুলো মুনাফা করলে অন্য বাসগুলো কেন করতে পারবে না, এমন প্রশ্ন যাত্রীরাই তুলছেন।
এই লাভের মুখ দেখা শুরু হয়েছে সম্প্রতি। ডিসেম্বরের শেষে যখন বাস সেবা চালু হয়, তখন যাত্রীদের মধ্যে প্রচার ছিল না সেভাবে। ফলে বাসগুলো অনেকটাই ফাঁকা চলেছে। ধীরে ধীরে যাত্রীরা এ সেবাতেই আস্থা রাখছেন বেশি। কারণ এটি যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানামা করে না; যাত্রীর জন্য কোথাও দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে হাঁকডাক করে বিরক্তির উদ্রেক করে না।
আবার নগর পরিবহনে চালকদের সুযোগ-সুবিধাও বেশি। বেসরকারি বাস কোম্পানির চালক ও তার সহকারী নির্ধারিত বেতনের বাইরে প্রতিদিন কেবল খাওয়ার খরচ হিসেবে পান ৫০০ টাকা। যদি দুটি ট্রিপের বেশি (যাওয়া-আসা) একটি ট্রিপ দেন, তখন সেই ট্রিপের জন্য দেওয়া হয় আরো ৫০০ টাকা। গত ৬ ফেব্রুয়ারির পর থেকে প্রতিদিনই লাভ করছে নগর পরিবহন। শুরুর দিকে দিনে এক থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হলেও বর্তমানে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হচ্ছে। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালক ও বাস রুট র্যাশনালাইজেশন কমিটির সদস্যসচিব নীলিমা আখতার বলেন, নগর পরিবহন লাভে চললেও এর পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনো করা হয় নাই।
কেন হিসাব করা হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, যিনি হিসাব রাখেন, তিনি করোনায় আক্রান্ত। আর পূর্ণাঙ্গ লাভ-লসের হিসাব করতে গেলে অন্তত তিন মাসের ডেটা লাগে। এ কারণেই এখনকার ডেটা ডিক্লিয়ার দিতে চাচ্ছি না, তবে এটুকুই বলছি, নগর পরিবহনে লাভ হচ্ছে।
নগর পরিবহন সরকার নির্ধারিত হারে ভাড়া নিয়ে যখন মুনাফায় আছে, সেখানে বেসরকারি অন্য বাসে কেন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে হয়, এমন প্রশ্নে একাধিক বাসমালিক জানান, চাঁদা আর শ্রমিকদের অর্থ আত্মসাৎ এর অন্যতম কারণ।
একজন বাসমালিক জানান, রুটভেদে দিনে ৬৫০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। অথচ এর এক টাকাও দেওয়ার কথা ছিল না। এই বাড়তি টাকা যাত্রীদের কাছ থেকেই তুলতে হয়।
সেই বাসমালিক এও বলেন, যাত্রীর কাছ থেকে তোলা সব টাকার হিসাব রাখতে ওয়ে বিল চালু করা হলেও সেটিও অর্থ আত্মসাৎ ঠেকাতে পারেনি। কারণ ওয়ে বিলের স্টপেজের পরে যে যাত্রী উঠে এবং পরের স্টপেজের আগে নেমে যাওয়া যাত্রীর কাছ থেকে তোলা ভাড়া কখনো মালিকরা পান না। আবার ওয়ে বিলের স্টপেজের কর্মী বাস শ্রমিকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাত্রীসংখ্যা কম লিখে দেয়। এটা এখন ওপেন সিক্রেট। এই সমস্যায় অনেক বাসমালিক এখন নিজেরাই যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা তোলা শুরু করেছেন বলেও জানান সেই মালিক।
বাস রুট র্যাশনালাইজেশন কমিটির সদস্যসচিব নীলিমা আখতার বলেন, ‘যাত্রী বাস ওনার’ অ্যাপের মাধ্যমে আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি আজকে কতগুলো টিকিট বিক্রি এবং কত টাকায় বিক্রি হয়েছে। কোন কাউন্টারে কত টিকিট বিক্রি হয়, সেটাও দেখতে পারি। এককথায় কাউন্টার ধরে ধরে আলাদা আলাদা তথ্য এই অ্যাপের মাধ্যমে দেখতে পারি।’
ঢাকা নগর পরিবহনের নতুন আরো তিনটি রুট চালুর ঘোষণা এসেছে। তবে এ জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়নি।