আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটের কারণে বাংলাদেশে প্রতি চারজন কর্মক্ষম যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে। শতকরা হিসেবে যা ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এই বেকারত্ব আরো বাড়ছে। আর বেকারত্বের হার বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এমন বাস্তবতায় সরকারের জন্য সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এজন্য আগামী পাঁচ বছরে (২০২১-২০২৫) ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির টার্গেটে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সরকার ১ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা আজ চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে যাচ্ছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক (২১-২৫) পরিকল্পনার আওতায় এই লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশে ৮১ লাখ ৭০ হাজার এবং প্রবাসে ৩৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। দেশের প্রতিটি জেলার মানুষ যাতে এই সুবিধা পায় সেজন্য জেলাগুলো থেকে বিদেশে কর্মী প্রেরণের সুযোগ সৃষ্টিতে সঠিক তথ্য, প্রশিক্ষণ, অভিবাসন ব্যয় মেটাতে ঋণ সহায়তাও দেওয়া হবে। ২০২১ সালে ২১ লাখ ৬০ হাজার, ২০২২ সালে ২২ লাখ ৩০ হাজার, ২৩ সালে ২৩ লাখ ৩০ হাজার, ২৪ সালে ২৪ লাখ ২০ হাজার এবং ২০২৫ সালে ২৫ লাখ ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
এদিকে, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধীনে নতুন কর্মসংস্থানের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার তুলনায় ১০ লাখ কম। কারণ, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অনেক লক্ষ্যই পূরণ হয়নি। ফলে সেগুলোর অনেক কিছু অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ঠাঁই পেয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় গত পাঁচ বছরে (২০১৬-২০) মোট কর্মসংস্থানের লক্ষ্য ছিল ১ কোটি ২৯ লাখ। এর মধ্যে দেশীয় ১ কোটি ৯ লাখ ও বিদেশি ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃজনের লক্ষ্য ছিল। পাঁচ বছর শেষে অবশ্য লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি, কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ৯৫ লাখ। এর মধ্যে দেশীয় ৬০ লাখ ও প্রবাসে ৩৫ লাখ। কোভিড-১৯ এর অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে এবার এনইসি সভায় উঠছে অষ্টম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। এই ধারাবাহিকতায় ২০-২১ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২০, ২১-২২ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২২, ২২-২৩ অর্থবছরের ৮ দশমিক ২৯, ২৩-২৪ অর্থবছরের ৮ দশমিক ৩২ এবং ২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ ধরে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ৫ দশমিক ২ শতাংশ, ৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সবশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নেমে আসবে ৪ দশমিক ৮ শতাংশে।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ধাক্কায় সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ।
জানা গেছে, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আজ মঙ্গলবার শেরে-বাংলা নগরের এনইসি সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। করোনা মহামারীর কারণে বিপর্যস্ত স্বাস্থ্যসেবা, আত্মবিশ্বাস, কর্মসংস্থান, আয় এবং অর্থনীতি কার্যক্রম পূর্বের ধারায় ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাসকরণে জোর দেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক নাগরিকের অংশগ্রহণ এবং তা থেকে উপকৃত হওয়া এবং দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া হবে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের দারিদ্র্য সমস্যা মোকাবিলায় কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিকে উচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এবং সুবিধাভোগীদের সংখ্যা বাড়ানো হবে। এসব জেলাগুলোতে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং আয় বৃদ্ধির জন্য কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ সেবার ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে প্রতি মিনিটে জন্মগ্রহণ করে ৫.৮টি নবজাতক। মৃত্যুবরণ করে ১.৬ জন। অর্থাৎ দেশে প্রতি মিনিটে ৪.২ জন, ঘণ্টায় ২৫৩ জন এবং প্রতিমাসে ১ লাখ ৮২ হাজার ১০০ জন জনসংখ্যা বাড়ছে। আর বছর শেষে মোট জনসংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ২২ লাখ নতুন শিশু। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের অন্তত ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী তরুণ কর্মক্ষম। যাদের বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছর। সরকারি চাকরিতে শূন্য পদের সংখ্যা ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮। করোনার কারণে গত ৬ মাস ধরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সব ধরনের নিয়োগ স্থগিত থাকায় এ সংখ্যা বর্তমানে ৪ লাখ ছাড়িয়েছে। এসব পদে নিয়োগ পেতে অপেক্ষায় আছেন ২০ লাখের বেশি শিক্ষিত বেকার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ডিগ্রি আছে এমন বেকারের সংখ্যা ৪ লাখ। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। করোনার কারণে বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। করোনার হানা যেন অনেকটা ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’।





