বিগত ১০ বছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা চার গুণ বেড়েছে। তবে এর সুফল পায়নি সাধারণ মানুষ। উল্টো এক দশকে বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে নয়বার। এতে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ করা বিদ্যুতের গড় দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
এদিকে শেষ দফায় পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালন তিন ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এর প্রভাব পরতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষের ওপর। এতে চলতি বছর বিদ্যুৎ বিলবাবদ জনগণের ব্যয় বাড়বে দুই হাজার ৬২৫ কোটি টাকা, দাম বৃদ্ধি বিষয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) আদেশ বিশ্লেষণে এমন তথ্যই পাওয়া যায়।
দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাধারণ জনগণ সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) থেকে। তাই সবচেয়ে বেশি অর্থ গুনতে হবে এ সংস্থার গ্রাহকদেরই। নতুন দাম কার্যকর হওয়ায় এ সংস্থার প্রতি ইউনিটে গড় বিদ্যুৎ বিল ছয় টাকা ২৬ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ছয় টাকা ৫৮ পয়সা। এতে শুধু বিআরইবির গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিলবাবদ ব্যয় বাড়বে এক হাজার ১৪৬ কোটি ২১ লাখ টাকা।
বিদ্যুৎ ব্যবহারের দিক থেকে পরের সংস্থা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এতে ২০২০ সালে পিডিবির গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিলবাবদ ব্যয় বাড়বে ৫১৩ কোটি ১১ লাখ টাকা। এছাড়া ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) গ্রাহকদের বিল ৪৩৫ কোটি ১০ লাখ টাকা, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ২৫২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, নর্দার্ন ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১৪৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা এবং ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১৩৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বেশি গুনতে হবে।
এদিকে বিগত ১০ বছরে নয় দফা বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে ২০১০ সালে এক দফা, ২০১১ সালে দুই দফা, ২০১২ সালে দুই দফা, ২০১৪, ২০১৫, ২০১৭ এবং ২০২০ সালে একবার করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ২০১০ সালের থেকে বর্তমানে বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে গড় মূল্য তিন টাকা ৭৩ পয়সা থেকে বেড়ে নতুন মূল্যহারে সাত টাকা ১৩ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এক দশকে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯১ দশমিক ১৫ শতাংশ।
এর মধ্যে ২০১০ সালের মার্চে প্রথম বিদ্যুতের দাম পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। সে সময় গড় বিদ্যুৎ বিল বেড়ে দাঁড়ায় তিন টাকা ৯২ পয়সা। পরের বছর (২০১১ সাল) গ্রাহক পর্যায়ে দুই দফায় পাঁচ শতাংশ ও ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় চার টাকা ৬৭ পয়সা।
আবারো এক বছর বাদে ২০১২ সালেও খুচরা বিদ্যুতের দাম দুই দফা বাড়ানো হয়। এর মধ্যে প্রথম দফায় সাত দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ এবং পরে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যাতে গড় মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সা। এরপর ২০১৪ সালের ছয় দশমিক ৯৬ শতাংশ, ২০১৫ সালের দুই দশমিক ৯৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ বেড়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ছয় টাকা ৭৭ পয়সা হয়েছিল। আর সর্বশেষ পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ বেড়ে বিদ্যুতের বর্তমান গড় দাম সাত টাকা ১৩ পয়সা।
এদিকে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রসঙ্গে ভোক্তা সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, বারবার সরকার যেসব ভূতুড়ে ব্যয়ের যুক্তি দেখিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে তা অযৌক্তিক। আমরা সব সময় সেগুলো দেখিয়ে গণশুনানিতে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু কাজ হয়নি।
তিনি বলেন, এ দফায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় যেভাবে অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে, সেসব প্রতিবিধানের কথা আমরা বলেছিলাম। বিদ্যুৎ খাতে নয় হাজার কোটি টাকার ওপরে অযৌক্তিক ব্যয় যদি সমন্বয় করা হতো তাহলে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির দরকার হতো না। বিদ্যুৎ খাতে প্রচুর দুর্নীতি রয়েছে। সেসব দেখা প্রয়োজন।
এদিকে দেশে এখন প্রায় ২২ হাজার (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ) মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। সবার জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা এবং ভবিষ্যতে বিদ্যুতের চাহিদার কথা বিবেচনা করে সরকার উৎপাদন ক্ষমতা আরো বৃদ্ধির মহাপরিকল্পনা নিয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে ৮৭টি নতুন কেন্দ্র থেকে ৩৯ হাজার ৮৬২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পরিকল্পনা ব্যস্তবায়ন হচ্ছে।
তার পরেও দেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় অসন্তোষ রয়েছে সাধারণ জনগণের মধ্যে। তারা বলছে, যখন বাজারের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সীমিত আয়ের মানুষ অসহায়, নানা শঙ্কায় তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্প খাত ঝুঁকিতে, তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কতটা যৌক্তিক? সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) জনগণকে সেবা দেওয়া থেকে বেশি ঝুঁকছে মুনাফায়।
এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যুতের এ দর বৃদ্ধিতে দেশের অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে। একদিকে যেমন প্রত্যক্ষভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়াবে, তেমনি শিল্প খাতে বড় ক্ষতি হবে। পিছিয়ে পড়বে উৎপাদন খাত, তার খড়্গও জনগণকেই বহন করতে হবে।