ধর্ম

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব

  • প্রকাশিত ৭ জুন, ২০২১

মাসুম আলভী

 

 

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার অর্থ হলো খোঁজখবর নেওয়া,  বিপদাপদে সাহায্য করা, মেহমানদারি করা, অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, দীনের ব্যাপারে উদাসীন হলে সতর্ক করা, সর্বোপরি উত্তম আচরণ করা। আত্মীয় প্রধানত দু প্রকার। যথা : ১. রক্ত সম্পর্কীয় বা বংশীয়। যেমন : পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, ভাই-বোন, চাচা-চাচি, মামা-খালা ইত্যাদি। ২. বিবাহ সম্পর্কীয় যেমন : শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালক-শ্যালিকা ইত্যাদি। সম্পদের অধিকারী হওয়ার দিক দিয়ে আত্মীয় দু প্রকার। যথা : ১. উত্তরাধিকারী; যেমন-পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা প্রভৃতি, ২. উত্তরাধিকারী নয়; যেমন-চাচা-চাচি, মামা-খালা ইত্যাদি। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রেহম (আত্মীয়তার সম্বন্ধ) আল্লাহর আরশের সঙ্গে ঝুলন্ত রয়েছে। সে বলে, যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে আল্লাহ তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন। আর যে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে আল্লাহ তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৬২৮৮)

ভাই-ভাই বন্ধনে ফাটল, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া, বউ-শাশুড়ি বিবাদ-কলহ,পবিরার, সমাজে বৈরী পরিবেশ তৈরি করে। সুশৃঙ্খলা ও ইসলামী সমাজ নির্মাণে অন্তরায়। অল্প বেতনের চাকরিতে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আবার বোন-ভাগ্নি! অশান্ত মন নিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার প্রশ্নই আসে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি রিজিকের প্রশস্ততা ও আয়ু বৃদ্ধি করতে চায়, সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে।’ (বুখারি, হাদিস নং-৫৫৫৯) আকাশচুম্বী প্রাচুর্যের অহংকারে কিংবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়ে হাজারও সুসংহত আত্মীয় সম্পর্কে চঞ্চলতা হারিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা জমিনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরাই যাদেরকে আল্লাহ লানত করেছেন, ফলে তাদেরকে বধির ও তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করে দিয়েছেন।’ (সুরা  মোহাম্মাদ, আয়াত-২২, ২৩)

খোঁজখবর নেওয়া : আত্মীয়তার সম্পর্ক সতেজ রাখতে যোগাযোগের বিকল্প নেই। কাজের ব্যস্ততা কিংবা মনোমালিন্যের জন্য আত্মীয় সম্পর্কের প্রাণ হারায়। সে খোঁজখবর নিচ্ছে না আমি কেন নেবো? তাদের সামাজিক মর্যাদা আর আমাদের মর্যাদার সাথে তাদের আত্মীয় সম্পর্ক যায় না, আগে যা ছিল সব ভুলো যাও। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘প্রকৃত আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী সেই যে ব্যক্তি তার আত্মীয়তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও সে তা রক্ষা করে চলে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৯৯১) আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা সকল বস্তু সৃষ্টি করেন। যখন তিনি সৃষ্টির কাজ সমাপ্ত করেন তখন আত্মীয়তার-সম্পর্ক বলে উঠল, ‘এটি আপনার কাছে আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্নকারী হতে আশ্রয়ের স্থান’। আল্লাহতায়ালা বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, যে ব্যক্তি তোমার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে আমিও তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবো আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে আমিও তাকে ছিন্ন করবো?’ আত্মীয়তার-সম্পর্ক বলল, ‘জি অবশ্যই, হে আমার রব’ তিনি বললেন, ‘এটা শুধু তোমার জন্য’। (সহিহ বুখারি)

উত্তম আচরণ করা : উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টন নিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্কের আচরণের অবনতি হয়। পারিবারিক অন্তঃকোন্দলের কারণে আত্মীয়তার সম্পর্কে ভাটা পড়ে। একে অপরের প্রতি সৌজন্যেবোধে উদাসীন হয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মা-বাবার সঙ্গে উত্তম আচরণ করো, আর উত্তম আচরণ করো নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে।’ (সুরা  নিসা, আয়াত- ৩৬) আত্মীয়স্বজনের প্রতি সহনশীল হওয়া ও সদ্ব্যবহার করা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার কিছু আত্মীয় আছে আমি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলি; কিন্তু তারা আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করি; তারা আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। আমি তাদের সাথে সহিষ্ণু আচরণ করি; তারা আমার সঙ্গে মূর্খের মতো আচরণ করে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি যেমনটি উল্লেখ করেছ যদি তুমি তেমন হও তাহলে তুমি যেন তাদের মুখে গরম ছাই ছুঁড়ে দিচ্ছ। তুমি যতক্ষণ এর ওপর অটল থাকবে ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে তোমার সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী থাকবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৫৫৮)

সহযোগিতার হাত প্রশস্ত করা : আত্মীয়স্বজন কোনো বিপদাপদ, অভাবগ্রস্ত হলে লজ্জায় মুখোমুখি না হতে পারলে গোপনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।  রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কোনো মিসকিনকে দান করলে শুধু দানের সওয়াব আর আত্মীয়কে সহযোগিতা করলে দুটি সওয়াব-দান ও আত্মীয়তা রক্ষা।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস নং-২৫৮২) আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আত্মীয়স্বজনকে তার হক দান করে দাও এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরদেরও। আর কিছুতেই অপব্যয় করো না।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-২৬) আত্মীয়স্বজন অনেক হলে নিকটাত্মীয়রা অগ্রাধিকার পাবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার রক্তের সম্পর্ক বজায় রাখে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬১৩৮)

মেহমানদারি করা : আত্মীয়তার সম্পর্ক অমলিন রাখতে মেহমানদারি হলো অন্যতম মাধ্যম। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলো দুই ঈদ। আত্মীয়স্বজনদের মিলনমেলা ঘটে। মেহমানদারিতে রয়েছে অনাবিল আনন্দ। এছাড়াও অন্য সময় মেহমানদারি আত্মীয়তার সম্পর্ক প্রাণবন্ত  করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে সে যেন মেহমানকে সম্মান করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস-৬১৩৮) আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত আরেক হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন আমল বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহর ইবাদত করো, তার সঙ্গে শরিক কোরো না। নামাজ ভালো করে আদায় করো এবং জাকাত দাও। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখো।’ (বুখারি, হাদিস নং-১৩০৯)

অসুস্থ হলে খবর নেওয়া : আত্মীয়স্বজন কেউ অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মোবাইলে খবর নেওয়া। মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা করা। প্রিয় কোনো খাবার রান্না করে নিয়ে যাওয়া। অতীত কোনো সুখস্মৃতির কথা স্মরণ করিয়ে আনন্দ দেওয়া। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে আহার করাও, রোগীর শুশ্রূষা করো এবং বন্দিদের মুক্ত করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৩৭৩) আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় করো রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়দের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর পর্যবেক্ষক।’ (সুরা নিসা, আয়াত-০১)

সতর্ক করা দীনের ব্যাপারে : পরিবার, আত্মীয় পরিজনরা দুনিয়ার জীবনে সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য আমরা সব সময় চেষ্টা করি কিন্তু চিরস্থায়ী আবাসস্থল পরকালের জন্য উৎসাহ প্রদান করি না। পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের জন্য সব সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করা। আত্মীয়স্বজন দীনের ব্যাপারে উদাসীন হলে আল্লাহর পথে আহ্বান করা। আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা নিজেদেরকে এবং পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করো জাহান্নামের আগুন থেকে, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত -৬)

বর্তমানে মানুষ নিজের গুটিকয়েক প্রিয় মানুষকে কেন্দ্র করেই মধুর সুসম্পর্ক গড়ে তুলে। কিন্তু এর বাইরের নিকট আত্মীয়ের সম্পর্ক তাদের কক্ষপথচ্যুৎ হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি) ইসলামী জীবন ও সুস্থ সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সেই সম্পর্ক রক্ষা করে, যা রক্ষার নির্দেশ আল্লাহ দিয়েছেন।’ (সুরা আর-রাদ, আয়াত-২১)

লেখক : শিক্ষার্থী,  ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads