রেলের কোচ কেনায় দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন করে অযোগ্য কোম্পানিকে কাজ প্রদান করাসহ ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) মোঃ শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে। ইন্দোনেশিয়া থেকে কোচ ক্রয় প্রক্রিয়ায় অস্বাভাবিক ঘুষ লেনদেন করে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। 

বাংলাদেশ রেলওয়ের সেবার মান বাড়াতে ২০১৭ সালে ২০০ মিটারগেজ কোচ কেনে সংস্থাটি। কিন্তু রেলের বর্তমান ডিজি  অনিয়ম করে কোচগুলো সরবরাহের কাজ পাইয়ে দেয় ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকা কোম্পানিকে।

এছাড়া এ কোচগুলো কেনা ছাড়াও রেলের বেশকিছু দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে মহাপরিচালক সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। আর এভাবে অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ তিনি হুন্ডির মাধ্যমে লন্ডনে পাচার করছেন।

এদিকে রেলের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন একটি কমিটিও গঠন করেছে। অনুসন্ধান কমিটির প্রধান হলেন দুদকের সহকারী পরিচালক (মানি লন্ডারিং) মামুনুর রশীদ চৌধুরী। কমিটির অন্য সদস্য হলেন দুদকের উপসহকারী পরিচালক সোমা হোড়। সম্প্রতি এ কমিটি রেলওয়ের মহাপরিচালক মোঃ সামসুজ্জামানের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য চেয়ে রেলপথ সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছে।

দুদকের গঠিত অনুসন্ধান কমিটিকে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪, দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা-২০০৭, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা ২০১৯-এর বিধান মোতাবেক অভিযোগ অনুসন্ধান কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অনুসন্ধানকালে কোনো ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধকরণ অথবা কোনো সম্পদ/সম্পত্তি ক্রোক করা হলে তা দ্রুত লিখিতভাবে দুদকের মানি লন্ডারিং শাখাকে অবহিত করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

কোচ ক্রয়ের নথিপত্রে দেখা যায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে ২০০ মিটারগেজ কোচ কেনার ক্ষেত্রে দরপত্রে শর্ত ছিল সরবরাহকারী কোম্পানিকে কমপক্ষে দেড় হাজার কোচ তৈরি ও সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইনকার সে যোগ্যতা না থাকায় পরে তা পরিবর্তন করা হয়। এক্ষেত্রে রেলওয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোঃ শামসুজ্জামান নিজে তা পরিবর্তন করে শর্ত দেন ৫০০ কোচ তৈরি ও সরবরাহের অভিজ্ঞতার। এতে কারিগরি যোগ্যতায় টিকে যায় পিটি ইনকা।

যদিও এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরে তদন্ কমিটি গঠন করা হলেও কোনো কাজ হয়নি; বরং ঘুষের বিনিময়ে সব পক্ষকে ম্যানেজ করেন ডিজি। এরপর আবার অতিরিক্ত মহাপরিচালক থেকে পদোন্নতি পেয়ে মহাপরিচালক হন মোঃ শামসুজ্জামান। এদিকে পিটি ইনকাকে কাজ দেওয়ার বিনিময়ে কোম্পানিটির স্থানীয় এজেন্ট বিশ্বাস বিল্ডার্স থেকে কয়েক কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেন শামসুজ্জামান। অবৈধভাবে উপার্জিত এ অর্থ বিশ্বাস বিল্ডার্সে পরিচালক আফসার বিশ্বাসের কাছে গচ্ছিত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদকে শামসুজ্জামানের অর্থ পাচারের অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ মোঃ শামসুজ্জামান হুন্ডির মাধ্যমে লন্ডনে পাচার করেন। মহাপরিচালকের ছেলে সাদমান জামানের ব্যাংক হিসাবে এসব অর্থ জমা হয়েছে। ব্যাংক ও শাখার নামও উল্লেখ রয়েছে নথিতে। তা হলো লন্ডনের বার্কলেস ব্যাংকের মুরগেট শাখা। শাখার ফোন নাম্বার ০৩৪৫৭৩৪৫৩৪৫।

এদিকে মহাপরিচালকের বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে বেশকিছু লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। এতে দেখা যায়, ২০১১ সালে যুগ্ম-মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) থাকাকালে ১০০টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ কোচ কেনায় প্রকল্প পরিচালক ছিলেন শামসুজ্জামান। সে সময় তিনি পিটি ইনকা থেকে নিম্নানের কোচ ক্রয় করেছিলেন। এছাড়া রেলের ১১০টি ট্রাকশন মোটর মেরামতে অনিয়মের মাধ্যমে ২৪ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন তিনি।

পাশাপাশি রেলের ২৬০০ ও ২৭০০ গ্রুপের ইঞ্জিন মেরামতের জন্য ১৫টি ট্রাকশন মোটর কানাডার ফেরদৌস ইন্টারন্যাশনাল থেকে আনা হয়। কিন্তু এগুলো খুবই নিম্নমানের, যার ক্রয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মোঃ শামসুজ্জামান। এছাড়া ২০০৬ সালে রেলভবনে সিএমই/প্রজেক্ট থাকাকালে বরাদ্দের বাইরে আট কোটি টাকা খরচ করেন তিনি, যা নিয়ে অডিট আপত্তি ওঠে।

এর বাইরে শামসুজ্জামানের অবৈধ সম্পদের বিষয়েও দুদকে অভিযোগ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ঢাকার শান্তিবাগে শামসুজ্জামানের আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে, যার মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। এছাড়া তার সাবেক স্ত্রীকেও একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া পূর্বাচলে সাড়ে সাত কাঠার প্লট, মিরপুরে সাড়ে তিন কাঠা জায়গা ও যশোরের ঝিকরগাছায় ৬০ বিঘা জমিসহ দুই তলা বাড়ি রয়েছে তার।

অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে মোঃ শামসুজ্জামান বলেন, দুদক এসব অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করছে। তাই দুদকের তদন্তনাধীন বিষয়ে বক্তব্য দেওয়া সম্ভব নয়।